নিষিদ্ধ হয়েই পুনরুত্থান, গণঅভ্যুত্থানে জামায়াতের রাজনীতিতে নতুন মোড়
অনলাইন ডেস্ক: ২০২৪ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে তৎকালীন সরকার। এর ঠিক চার দিন পরেই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে দেড় দশক পর জামায়াতের রাজনীতির পথ অবারিত হয়ে উঠে। আগামী এয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচিতে দলটি এখন রাজনীতির মাঠে বেশ সরব।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সন্ত্রাস ও সহিংসতার অভিযোগ এনে স্বাধীন দেশে দ্বিতীয়বারের মতো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২৮ আগস্ট সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি চারবার নিষিদ্ধ হয়। পাকিস্তান আমলে দুইবার এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর অন্য সব ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল।
পরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী। আদালতের রায়ে নির্বাচন কমিশন ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে। জামায়াতের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল থেকে যায়। দলটি এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
১৩ বছর পর আজান দিয়ে কার্যালয় চালু
৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ঢাকাসহ সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর দলীয় কার্যালয়গুলো সচল হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন রাতেই দলটির নেতাকর্মীরা মগবাজারে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। আজান দিয়ে খোলা হয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এ সময় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। নেতারা দীর্ঘদিন পর কার্যালয়ে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বিশেষ মোনাজাত করেন। পরে তারা পুরানা পল্টনে মহানগর কার্যালয়েও যান।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে দলটি নানা কৌশলে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। এখন সারাদেশের দলীয় কার্যালয়গুলো বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। নতুন করে উপজেলা, ইউনিয়ন, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও দলীয় কার্যালয় চালু করা হচ্ছে।
১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সদস্য (রুকন) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯ বছর প্রকাশ্যে জামায়াতের রুকন সম্মেলন
ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের ফলে অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১৯ বছর পর প্রকাশ্যে বড় পরিসরে রুকন সম্মেলন করেছে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা। গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই স্থানে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের রুকন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসব সম্মেলন থেকে দুই মহানগর শাখার আমির নির্বাচন করা হয়। সর্বশেষ ২০০৫ সালে পল্টন ময়দানে বড় পরিসরে অভিন্ন ঢাকা মহানগরের রুকন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
রাষ্ট্রীয় সভায় জামায়াতের কদর
শেখ হাসিনার পালানো পর দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে ৫ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই বৈঠকে দাওয়াত পান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকলেও তখন জামায়াত আমিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন সেনাপ্রধান।
২৮ নভেম্বর রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েক বার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন। প্রতিবারই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ডাক পেয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিচারালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াত সমর্থক ব্যক্তিরা ভালো অবস্থানে আছেন
কদর বেড়েছে কূটনীতিতেও
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কূটনৈতিক অঙ্গনে জামায়াতের সমাদর বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত অধিকাংশ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। আমন্ত্রণ পেয়ে অংশ নিচ্ছেন তাদের চা কিংবা লাঞ্চ বা ডিনারে। দলের মগবাজার কার্যালয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করে এসেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা।
বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও বৈঠক করেছে জামায়াতে ইসলামী। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর গুলশানে জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এই বৈঠকে অংশ নেয়।
২৭ নভেম্বর জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নেতৃত্বে চীন সফরের যায় কয়েকটি ইসলামিক দল।
গত ২৭ নভেম্বর চীন সরকারের আমন্ত্রণে প্রথমবারের মতো বেইজিং সফরে গেছে কয়েকটি ইসলামিক দল। যার নেতৃত্বে ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতসহ কোনো ইসলামি দলের নেতাদের চীনের ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রণে সে দেশে যাওয়ার ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা
২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত।
দলটির নেতারা জানান, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রথমত, জামায়াত নিজেরাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে। দ্বিতীয়ত, ইসলামি দলগুলো তাদের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইলে সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগি করা হবে।
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।সেখানে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করেন।
জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে অব্যাহতবাবে চাপে রাখলেও জামায়াত শুরু থেকে ভোটের আগে সংস্কারকে সংস্কারকে প্রাধান্য দিচ্ছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে বড় পরিবর্তনের কথা বলছে জামায়াতসহ অধিকাংশ ইসলামী দল। তারা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে জাতীয় সংসদে দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা চান। তাদের দাবি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে আনুপাতিক হারে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দল সংসদে তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করবে।
এদিকে দেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের জন্য বাম ধারার দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার। জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের পক্ষে মত জানিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিটিতে প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপি আনুপাতিক হারে নির্বাচনের পক্ষে নয়।
ইসলামপন্থিদের নিয়ে নির্বাচনি জোট গড়ার চেষ্টা
ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গড়ে সংসদ নির্বাচনে লড়ার চিন্তা করছে জামায়াতে ইসলামী। এ লক্ষ্যে দলটি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল এবং আলেমদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, বিভিন্ন কারণে বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির সঙ্গে তাদের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগামী সংসদ নির্বাচনে ভালো রেজাল্টের জন্য ইসলামপন্থিদের সঙ্গে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইছেন। যদিও তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো রূপ নেয়নি।
১৮ আগস্ট দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, দলগুলোর মধ্যে কিছু মতপার্থক্য আছে। জোট গঠনের ক্ষেত্রে পার্থক্যগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পার্থক্যগুলো নিজেদের জায়গায় রেখে ন্যূনতম সাধারণ কিছু ইস্যুতে ঐক্যের ফর্মুলা বের করা হচ্ছে।
তিনি বলেন,পটপরিবর্তনের পর জামায়াত ব্যতিক্রমধর্মী কিছু কাজ করেছে, যেমন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত এক হাজার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। শীতবস্ত্র বিতরণসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করছেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এগুলো করতে সব জেলায় সফর করছেন দায়িত্বশীল নেতারা। এর মাধ্যমে সংগঠনের জনসংযোগ কার্যক্রম বাড়ছে।
অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমাদের সাংগঠনিক কাজ সবসময়ই ছিল, এখন হয়তো পরিবেশ বাধাহীন হওয়ার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রমটা সবার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে। সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী সভা-সমাবেশ করছে। মানুষ ব্যাপকভাবে জামায়াতের কর্মসূচিতে সাড়া দিচ্ছেন। ইনশাল্লাহ, আমরা জাতিকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারবো। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক