প্রশ্নপত্র ফাঁসে ৭ চক্র: তালিকায় পিএসসির সাবেক সদস্য, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও

অনলাইন ডেস্ক: সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত সাতটি চক্র শনাক্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২৪ বছর ধরে সক্রিয় এসব চক্র বিসিএস ও নন-ক্যাডারের ৯টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেই থেমে থাকেনি চক্রের তৎপরতা। রীতিমতো ঘর ভাড়া করে সেখানে পরীক্ষার্থীদের উত্তরও শেখাতেন চক্রের সদস্যরা।

ইতিমধ্যে চক্রের ২২ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। তাঁদের মধ্যে সাতজন অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে চক্রের ৩৫ সদস্যের নাম এসেছে। এ তালিকায় আছেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক সদস্য, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও।

আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া ব্যক্তিরা হলেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী (আবেদ আলী চক্রের প্রধান), অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম (সাজেদুল চক্রের প্রধান) ও ডেসপাস রাইডার মো. খলিলুর রহমান (খলিলুর রহমান চক্রের প্রধান), জাহিদুল ইসলাম (জাহিদুল চক্রের প্রধান) ও পানির ফিল্টার ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন (সাখাওয়াত চক্রের প্রধান)। এ ছাড়া জাহিদুল চক্রের সদস্য লিটন সরকার ও সাখাওয়াত চক্রের সাইম হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

জবানবন্দিতে এই ব্যক্তিরা ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৯টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন বলে জানিয়েছেন। এর নেপথ্যে ছিলেন পিএসসির একজন সাবেক সদস্য ও একজন উপপরিচালক।

পরীক্ষাগুলো হলো বিসিএস, নন-ক্যাডারের বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী, থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, অডিটর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ইনস্ট্রাক্টর ও জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স।

প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৮ জুলাই পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী, দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া আবেদ আলী তখন ব্যাপক আলোচনায় আসেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা আইনে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে সিআইডি। সংস্থাটির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। ৫ জুলাই রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস করেন গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা। তাঁরা পরীক্ষার আগের দিন রাতে চুক্তি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে প্রশ্নপত্র ও এর উত্তর জানিয়ে দেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসে ৭ চক্র
সৈয়দ আবেদ আলীর চক্রের সদস্যরা হলেন আল আমিন, মাহমুদুল হাসান (মান্না), ওয়াসিম, সুমন বোস, বিপাশ চাকমা ও পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।

সাজেদুল ইসলাম চক্রে আছেন, আবু সোলায়মান ওরফে সোহেল। খলিলুর রহমান চক্রে আছেন পিএসসির একজন উপপরিচালক ও এমএলএসএস দেলোয়ার হোসেন, সাবেক সৈনিক নোমান সিদ্দিকী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নেয়ামুল হাসান, আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মাহবুব ও আজাদ।

বিজি প্রেসের কর্মচারী আতিকুর রহমান ওরফে আতিকের চক্রে আছেন তাঁর মামা পিএসসির একজন সদস্য, ছোট ভাই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোজাহেদুল ইসলাম, খালা শিউলি বেগম, বিজি প্রেসের কম্পোজিটর এ টি এম গোলাম মোস্তফা, কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ও গাড়িচালক মিজানুর রহমান (মোস্তফার আত্মীয়), মিজানুরের শ্যালক আল মামুন, চাঁদপুরের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান ওরফে দীপু, হামিদুল ইসলাম ওরফে জিয়া, কুমিল্লার জুয়েল ও শহীদ।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার একটি মহিলা কলেজের শিক্ষক মাহফুজুর রহমানের চক্রে আছেন মাহফুজ।

জাহিদুল ইসলামের চক্রে আছেন খোকন ও লিটন সরকার। সাখাওয়াত হোসেনের চক্রে আছেন সাইম হোসেন।

৩ ডিসেম্বর যোগাযোগ করা হলে মামলার তত্ত্বাবধানকারী সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) সদ্য বিদায়ী উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এন মো. নজরুল ইসলাম (ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কর্মরত) প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তকাজ এখনো চলছে। আদালতে সাতজনের জবানবন্দিতে পিএসসির এক সদস্য ও আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ যাঁদের নাম এসেছে, তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। পিএসসির যে সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি এখন অবসরে।

জবানবন্দিতে যা উঠে এল
আবেদ আলী জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ১৯৯৭ সালে পিএসসিতে গাড়িচালক পদে যোগ দেন। ৫ জুলাই অফিস সহায়ক সাজেদুলকে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের প্রার্থী এনে দেন। প্রত্যেক প্রার্থীর সঙ্গে প্রশ্নপত্র সরবরাহ বাবদ তিনি ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন এবং অগ্রিম টাকা নেন। সাজেদুলের মাধ্যমে তিনি (আবেদ) রমনা পার্কের ফটকে টাইপ করা প্রশ্নপত্র হাতে পান। প্রশ্নপত্র সরবরাহ বাবদ সাজেদুলকে ৭৫ লাখ টাকা দেন। সাভারের রেডিও কলোনির একটি রিসোর্টে তিনি একটি বুথ করে তাঁর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৪৪ জন প্রার্থীকে প্রশ্নপত্রের উত্তরপত্র দেন।

আবেদ আলী আদালতকে বলেন, ২০০৫ সালের দিকে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের এক কলেজশিক্ষকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর মতো মাহফুজও সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকের চাকরি দিতে পারেন। ২০১৫ সালে মাহফুজের মাধ্যমে রংপুরের আতিকুর রহমান নামের একজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। আবেদ আলীকে আতিক বলেন তিনি রাজস্ব বোর্ডের অধীন রাজস্ব কর্মকর্তা পদে চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাজেদুল ইসলাম বলেন, তিনি পিএসসিতে ২০ বছর ধরে চাকরি করছেন। বিজি প্রেসের কর্মচারী আতিকের মাধ্যমে তিনি পিএসসির বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করতেন। পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি (আতিক)।

৫ জুলাই রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন সাজেদুল পিএসসির এক সদস্যের চেম্বার থেকে ফাঁস করেন। সাজেদুল জবানবন্দিতে বলেন, চক্রের সদস্য আবু সোলায়মান ওরফে সোহেলের মাধ্যমে জানতে পারেন, ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ৪৬তম বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁস হবে। তখন তিনি সোলায়মানের কাছে ১৭ জন প্রার্থী দেন। এর মধ্যে পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান দেন ১২ জন। এই প্রার্থীদের প্রশ্নপত্র ও উত্তর সরবরাহ করেছিলেন সোলায়মান। এর আগে প্রশ্নগুলো দৈনিক বাংলার মোড়, মালিবাগসহ বিভিন্ন জায়গায় কম্পোজ করা হয়। এরপর ঢাকা শহরে চারটি গোপন বুথ স্থাপন করে প্রার্থীদের উত্তরপত্র জানানো হয়।

জবানবন্দিতে খলিলুর রহমান বলেন, তিনি ২০০৫ সালে পিএসসিতে ডেসপাস রাইডার হিসেবে যোগ দেন। তিনি জানতে পারেন, আবেদ আলী বিসিএসসহ বিভিন্ন নন–ক্যাডারের চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। আবেদ আলী তাঁকে নন–ক্যাডারের পরীক্ষার্থী জোগাড় করে দিতে বলেন এবং অর্থের লোভে সখ্য গড়ে তোলেন। চক্রের সদস্য নিয়ামুল, আনিসুর, মাহবুবুর ও আজাদ চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীদের কাছ থেকে অগ্রিম ১৫ লাখ টাকা নিয়ে তাঁকে (খলিলুর) দেন। পরে এ ১৫ লাখসহ তিনি সাজেদুলকে ৩৫ লাখ টাকা দেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসে পিএসসির একজন উপপরিচালকও জড়িত বলে আদালতকে জানান খলিলুর।

মোজাহেদুল ইসলাম জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর বড় ভাই আতিকুর রহমান ২০০১ সালের পর থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে যুক্ত হন। তিনি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা, সিনিয়র স্টাফ নার্স, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মকর্তা, অডিটরসহ বেশ কিছু পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেন। আর তিনি (মোজাহেদুল) ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষা ও জুলাইয়ে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া ২০২৩ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ইনস্ট্রাক্টর ও জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ছিলেন।

মোজাহেদুল বলেন, তাঁদের এক আত্মীয় (আতিক) পিএসসিতে যোগ দেওয়ার পর বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করা চক্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। চক্রের ফাঁস করা ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএসের প্রশ্নে বিপুলসংখ্যক প্রার্থী বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। ৩০তম বিসিএসের ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে এক ব্যক্তি পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস করা প্রতিদ্বন্দ্বী চক্রকে চাপে রাখতে এ পুলিশ কর্মকর্তাকে ব্যবহার করতেন আবেদ আলী। এই পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিদ্বন্দ্বী চক্রকে ভয় দেখিয়ে আবেদকে একা কাজ পাইয়ের দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ওই কর্মকর্তা এখন পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না কোনো ফাঁস করা প্রশ্ন পড়ে আমি বিসিএস অফিসার হয়েছি; বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের ধরিয়ে দিতে আমি সিআইডিকে সহযোগিতা করেছিলাম। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তি এমন অভিযোগ করতে পারেন। তা ছাড়া আমি কাউকে ভয় দেখাইনি।’

‘অভিযোগের প্রমাণ পায়নি কমিটি’
এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের পর পিএসসি যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সেই কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো প্রমাণ পায়নি বলে সম্প্রতি পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রসঙ্গে ১৪ ডিসেম্বর চাকরিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁস রোধে প্রথম কাজ হচ্ছে সৎ ও ভালো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে হবে। এটা না হলে প্রশ্ন ফাঁস হবেই। প্রশ্ন ফাঁস একজন করতে পারেন না। এতে একটি গ্রুপ লাগে। তিনি আরও বলেন, পিএসসিতে চৌকস চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দিতে হবে। প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে হলে সৎ কর্মকর্তাদের দিয়ে আলাদা নজরদারি কমিটি করে দিতে হবে। তদন্ত সাপেক্ষে যাঁদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

আদালতে আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরও পিএসসি যদি বলে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মন্তব্য করেন ফিরোজ মিয়া। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো

Related Articles

Back to top button