ঠেকানোর নামে কয়েকশ কোটি টাকা গচ্চা

অনলাইন ডেস্ক: এপ্রিল থেকে জুন বজ্রাঘাতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৪ লাখের বেশি বজ্রপাত হয়, যার ৭০ শতাংশই হয় এই তিন মাসে। এই সময়ে ঝড়-বাদলের সঙ্গে আকাশ ফুঁড়ে ভূমিতে নেমে আসা ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো তাপমাত্রার বজ্র হঠাৎ আলোর ঝলকানি হয়ে আঘাত করে। ঋতুভিত্তিক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ পরিগ্রহ করেছে এই প্রাণঘাতী বজ্রপাত। সমুদ্রের জলীয় বাষ্প এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আর ভূমির শুষ্কতা বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে। গত কয়েক দিনে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গতকাল এক দিনেই ছয় জেলায় বজ্রপাতে ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে হাওর-বাঁওড়, খেত-খামার-উন্মুক্ত মাঠ-ঘাটে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। হাওরাঞ্চলে এই মৌসুমে বজ্রপাত যেন আতঙ্কের নাম। এই প্রাকৃতিক মরণঘাত থেকে রেহাই পেতে গত এক দশক ধরে নানা ধরনে প্রকল্প নেওয়া হলেও তা কার্যত লুটপাট এবং লোক দেখানো ছিল বলে মনে করছেন তারা।
২০১৬ সালে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতকে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণা করে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার। এরপর এ দুর্যোগ ঠেকানোর নামে নেওয়া হয় একের পর এক প্রকল্প। কিছুদিন পর সেই প্রকল্প ব্যর্থ হলে ফের নেওয়া হয় নতুন প্রকল্প। এভাবে প্রকল্প নেওয়া আর ব্যর্থতার মধ্যে কিছু মানুষের আর্থিক ভাগ্যের পরিবর্তনও ঘটে। এদিকে নিত্যনতুন প্রকল্পের ভিড়ে গচ্চা গেছে শত শত কোটি টাকা। বজ্রপাত ঠেকাতে ২০১৭ সালে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে তালগাছ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ‘বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছই ভরসা’ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয় তালগাছ লাগানোর মেগা প্রকল্প। সরকারের তরফ থেকে সারা দেশে কোটি তালের চারা রোপণের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। কয়েক লাখ তালের আঁটি ও তালগাছ রোপণের পর কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে, তালগাছের মাধ্যমে বজ্রপাত ঠেকানো যাবে না। তবে ততদিনে গচ্চা গেছে শত কোটি টাকা। এ প্রকল্পের অধীনে কিছু এলাকায় স্বল্পসংখ্যক তালগাছ লাগানো হলেও সেই চারার চিহ্নমাত্র নেই। আর আঁটি থেকে চারা জন্মানো তো দূরের কথা, আঁটিরও হদিস নেই। বিষয়টি ধরা পড়ে ২০২২ সালে। এরপর প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
পরে তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান জানান, তালগাছ প্রকল্প ভুল ছিল। ৩৮ লাখের মতো তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেল, যত্নের অভাবে সেগুলো মারা যাচ্ছে। তাই এটি বাতিল করে দিয়েছি। আর একটি তালগাছ বড় হতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় লাগে। তাই এটি বাতিল করা হয়েছে। তালগাছের পর দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়। যা আর অগ্রসর হয়নি।
একের পর এক প্রকল্প ব্যর্থ এবং লুটপাটের পর ২০২২ সালে বজ্রপাত ঠেকাতে নেওয়া হয় আরেকটি নতুন প্রকল্প। তখন বলা হয়, মানুষ ও প্রাণীদের রক্ষায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের (টিআর) আওতায় ১৫টি জেলায় ‘লাইটেনিং অ্যারেস্টার’ বসানোর কথা বলা হয়। এ লক্ষ্যে ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কর্মসূচির আওতায় ১৩৫ উপজেলায় মোট ৩৩৫টি বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হয়েছে। পরে দেখা যায়, এসব জায়গায় আসলে দণ্ড বসেনি। লুটপাট হয়েছে অর্থ। এ নিয়ে এখন চিঠি চালাচালি আর তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।