বাংলাদেশের বহুত্ববাদীতা অক্ষুণ্ণ থাকতে হবে: আলী রীয়াজ 

অনলাইন ডেস্ক: বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দলিল পর্যালোচনা ও সংশোধনের বিশাল কাজ সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-লেখক অধ্যাপক আলী রীয়াজের বিশেষ সাক্ষাৎকার (সংক্ষেপে)

  • (অধ্যাপক) আলী রীয়াজ বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
  • সংবিধানটিতে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।
  • সুপারিশ আসছে দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট আইনসভার এবং ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের।

বাংলাদেশি-আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং লেখক অধ্যাপক আলী রীয়াজের হাতে রয়েছে অন্যতম একটি জটিল কাজ। বাংলাদেশে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে দেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন দলিলটি পর্যালোচনা করে সংবিধান সংশোধন অথবা পরিবর্তনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া।

১৫৩টি অনুচ্ছেদ, ১১টি ভাগ এবং চারটি তফসিল নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানটি সম্ভবত উপমহাদেশের সবচেয়ে জটিল সংবিধানগুলির মধ্যে একটি। তবে রীয়াজ এবং তাঁর দল এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক করার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করতে নারাজ (সম্ভব সবটুকু করতে চান)।

ঢাকার সংসদ ভবন সংলগ্ন তাঁর অফিসে, যেখানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের অন্যতম শহিদ আবু সাঈদের ছবি ঝোলানো আছে, সেখানে বসে ভারতের ইন্ডিয়া টুডে-এর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) এক সাক্ষাৎকারে জানান কীভাবে তিনি কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বাংলাদেশের জন্য এগিয়ে যাওয়ার পথ কী হতে পারে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি শুধুমাত্র তার সংবিধান সংশোধন করছে, নাকি এটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে লেখা হচ্ছে, এ নিয়ে অনেক আলোচনা এবং কৌতূহল রয়েছে। আপনার কী মতামত?

এই কাজের পরিধি কেবল সংশোধন বা নতুন করে লেখা হিসেবে সীমাবদ্ধ করা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে, এটি উভয়ের কিছুটা। কিছু ধারা পুরোপুরি বাদ বা পরিবর্তন করতে হবে, অন্য কিছু ক্ষেত্রে কিছু শব্দ পরিবর্তন করা যথেষ্ট হবে। আমাদের কাজের লক্ষ্য হল সংবিধানকে সরল ও সহজ করা। শেষ পর্যন্ত, এটি জনগণের সংবিধান। যদি আইনের জটিল ভাষা এবং জটিলতা দিয়ে এটি কঠিন ভাষায় লেখা হয় তাহলে সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না। এজন্যই আমাদের সুপারিশ হবে এটি সহজ এবং সরল রাখা।

আমাদের কাজ দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমে, আমরা সংবিধান পর্যালোচনা করেছি। আমরা পরীক্ষা করেছি এবং আলোচনা করেছি যে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এটি কিভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এখন আসে বিচারশাস্ত্রের প্রশ্ন: এর ত্রুটিগুলো কোথায়, কী পরিবর্তন প্রয়োজন ইত্যাদি। দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিবর্তন এবং সংশোধনের প্রস্তাবনা দেওয়া হবে। আমাদেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে আমি সরকারকে বলেছি, যেহেতু আমি ৭ অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করেছি, আমার তিন মাসের সময়সীমা ৬ জানুয়ারি শেষ হবে, এবং আমি পুরো সময়ব্যাপ্তি ব্যবহার করব। (হাসির সাথে)

প্রশ্ন: এই বিপ্লবটি মানুষের দায়িত্বশীল এবং গণতান্ত্রিক সরকারের দাবির সঙ্গে সম্পর্কিত। কমিশন দেশের জন্য কোন ধরনের সংসদের সুপারিশ করবে?

আমরা যেসব অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) এবং বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন যে আমরা যেন দ্বিকক্ষিবিশষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করি, যার অর্থ হচ্ছে আইনসভায় দুটি আলাদা সংসদীয় কক্ষ থাকবে, যেমন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন দেশের এই ব্যবস্থাটি অধ্যয়ন করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে, দুটি কক্ষ সমান, তবে ভারতে রাজ্যসভার হচ্ছে উচ্চ কক্ষ আর লোকসভা হচ্ছে নিম্নকক্ষ। আমরা এগুলোর সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছি এবং আমাদের চূড়ান্ত সুপারিশ সময়মতো আসবে।

অন্যদিকে, এটা আবশ্যকীয় যে আমাদের সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করতেই হবে। সংসদের ফ্লোর ক্রসিং করে এটি সংসদের সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দলের বিপক্ষে ভোট দিলে, সদস্যগণ তাদের আসন হারিয়ে ফেলে। এই ব্যবস্থা শাসকদলকে সহায়তা করে অনুচ্ছেদটিকে রাবার স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতে যাতে সংসদ কখনোই প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের জন্য অনাস্থা প্রস্তাব দিতে পারবে না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। সদস্যদের অবশ্যয় তাদের স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশের জন্য ক্ষমতায়িত করতে হবে যাতে শাসকগণ সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এরপর ২০১১ সালে, ১৫ তম সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের এক তৃতীয়াংশ অপরিবর্তনীয় করা হয়। এই কঠোরতা পর্যালোচনা করতে হবে এবং আমরা পরীক্ষা করছি।

প্রশ্ন: প্রস্তাবনার প্রসঙ্গটি কেমন হবে? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ‘জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ কথাটি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

অবশ্যই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা সেখানে থাকবে। তবে এই ভূখণ্ডটির দীর্ঘকালীন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। বাংলার মানুষ ব্রিটিশ সহ সকল আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এই চেতনাও কেন সেখানে উল্লেখ করা উচিৎ নয়? এবং জুলাই-আগস্টের বিপ্লব, যা ছাত্র ও সাধারণ মানুষের নেতৃত্বে হয়েছিল, অবশ্যই এটি যথাযথভাবে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা উচিত। এটি ছিল এই বিপ্লব নতুন বাংলাদেশ ও অধিকতর কল্যাণের জন্য নতুন সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা এবং সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এটি হবে আমাদের সুপারিশ।

প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থাকবে যেখানে রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম?

আপনাকে কয়েকটি কথা বলি। আমার একটি কোর্সে আমি শিক্ষার্থীদের শেখাই যে পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ দেশেই একটি রাষ্ট্রধর্ম আছে। এটা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ হতে বাধা দেয় না। এমনকি আমার শিক্ষার্থীরা এটি জানার পর অবাক হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে, আমি মনে করি, আমাদের সংবিধানের বাংলায় এই শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা একটি দর্শন। আমরা শব্দের খেলা নিয়ে বিভ্রান্ত না হই। আমরা যা বলছি, তা হলো যে বাংলাদেশে বহুত্ববাদী চেতনা যেকোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ থাকতে হবে। এর অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া কখনো পরিবর্তন করা উচিত নয়, কারণ এটি আমাদের ভিত্তি। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে অন্যদের থেকে উচ্চতর হতে পারে না। সবাই, এক একক ব্যক্তি পর্যন্ত, সমান থাকতে হবে এবং থাকবে।

প্রশ্ন: গত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে মূলনীতি ছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা’ সম্পের্ক আপনার মতামত কী?

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছিল, যা আমাদের পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত ছিল: সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানব মর্যাদা। এই তিনটি বিষয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল কিন্তু এক বছর পরে কেউ সেগুলি মনে রাখেনি। এগুলোকে জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। আমি মনে করি, সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানব মর্যাদাই আমাদের মৌলিক নীতি হওয়া উচিত।

প্রশ্ন: যখন এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তখন একটি সমালোচনা ছিল যে, এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

উত্তর: আমি স্বীকার করি যে এটি একটি ভুল হয়েছে। আমি তা অস্বীকার করতে পারি না। তবে বলুন তো, তাদের অংশগ্রহণ কি তাদের পক্ষে ন্যায় নিশ্চিত করতে পারে? এটি ইচ্ছার ব্যাপার, এবং আমাদের উদ্দেশ্য হলো তাদের সমানভাবে বিবেচনা করা।

প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন, এই বিশাল কাজ আপনি কীভাবে পরিচালনা করছেন?

আমি একা নই। আমার একটি দুর্দান্ত দল রয়েছে, যার মধ্যে অধ্যাপক, গবেষক এবং অন্যান্য সদস্যবৃন্দ রয়েছেন যারা আমার জন্য কাজ করছেন। আসলে, দলের নয় সদস্যের মধ্যে—আমি নিজে—শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন অধ্যাপক একে অপরকে আগে চিনতেন। তাছাড়া, আমরা একে অপরকে চিনতাম না। তবে আমরা একত্রে কাজ করেছি।
এটা সহজ ছিল না। তবে এটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। আমরা ২৬টি রাজনৈতিক দল এবং তিনটি জোটের কাছ থেকে লিখিত সুপারিশ সংগ্রহ করেছি, আমাদের ওয়েবসাইটে ৫০,০০০-এরও বেশি সুপারিশ পেয়েছি, ৩০টিরও বেশি নাগরিক সমাজ সংস্থার সাথে সাক্ষাৎ করেছি, ৯ জন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১১ জন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আমাদের জন্য একটি জরিপ করেছে, যেখানে ৪৬,০০০টি পরিবারের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। আমার ১৫ জন সদস্য এবং ৯ জন গবেষক রয়েছেন, যারা স্বেচ্ছায় কাজ করছেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলি খতিয়ে দেখার জন্য। আমরা জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলির সংবিধানগুলি পর্যালোচনা করেছি, যাদের জনসংখ্যা ১০ মিলিয়ন বা তার বেশি। এছাড়া, আমরা ছোট জনগণের দেশগুলির সংবিধান যেমন সিঙ্গাপুরের সংবিধানও দেখেছি। এটি একটি বিশাল প্রক্রিয়া ছিল। আপনি যে ফলাফলগুলি দেখবেন তা একটি যৌথ, আলোচিত এবং গবেষণামূলক প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা।

আমরা সবাই এ কাজ করছি এর একটা কারণ আছে। (আবু সাঈদের প্রতিকৃতির দিকে ইঙ্গিত করে) তিনি এবং তার মতো মানুষরা আমাদের এই স্বাধীনতা দিয়েছেন। আমরা এই শহীদদের প্রতি ঋণী, এবং আমাদের কাজ সততা এবং পরিশ্রমের সঙ্গে করতে হবে, যাতে আমরা আমাদের দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রদান করতে পারি, যা আমাদের সবার জন্য হবে। আমি তার প্রতিকৃতিটি অনুস্মরক হিসেবে রেখে দিয়েছি। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

Related Articles

Back to top button