সরকারি পর্যায়ে ফেরত দিতে নানা তৎপরতা

অনলাইন ডেস্ক: পদ্মা ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক (সরকারি-বেসরকারি) আমানত আছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ব্যক্তি আমানত ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্ষুদ্র আমানত ৫০০ কোটি টাকা। অল্প টাকার যেসব ব্যক্তির আমানত সে টাকাই ফেরত দিতে পারছে না অথচ সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দেওয়া নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা ঠিক নয়। আগে ব্যক্তি পর্যায়ের আমানত ফেরত দিতে হবে। এরপর সরকারি আমানত।

জানা গেছে, সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের টাকা ফেরতে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি সভা ডাকা হয়। সে সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পদ্মা ব্যাংকের নতুন পর্ষদ গঠন হলে প্রথম পর্ষদ সভায় জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরতে অগ্রাধিকার দিয়ে আলোচনা করা হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা যুগান্তরকে বলেন, সম্প্রতি জলবায়ু তহবিলের টাকা ফেরতে পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে। যেহেতু ব্যাংকটির এখন বোর্ড নেই তাই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, বোর্ড গঠন হলে প্রথম সভায় জলবায়ুর টাকা ফেরতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এদিকে একাধিক ক্ষুদ্র আমানতকারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সাধারণ মানুষ টাকা পাচ্ছেন না অথচ সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক টাকা ফেরতে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এটা উচিত নয়। খেটে খাওয়া মানুষ যে টাকা জমিয়েছে সে টাকা আগে দিতে হবে।

জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কাজী মু. তালহা যুগান্তরকে বলেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন হতে পারে। তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। তবে বাস্তবতা হলো তারল্য সংকটে আছি। এটা সবাই জানে এবং বোঝে। নতুনভাবে কিছু বলার নেই।

জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের কাছে আটকে থাকা জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের ৮৭৪ কোটি টাকা উদ্ধারে পথনকশা চেয়েছে সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পদ্মা ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমান পদ্মা ব্যাংক) গুলশান, মতিঝিল ও গুলশান সাউথ অ্যাভিনিউ শাখায় এক বছর মেয়াদে ৫০৮ কোটি টাকা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিল থেকে স্থায়ী আমানত হিসাবে রাখা হয়।

মেয়াদ শেষে সুদাসল পরিশোধ না করায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটি নবায়ন করা হয়। ওই সময় পর্যন্ত কয়েক দফায় পদ্মা ব্যাংক মাত্র ৮০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত সুদ-আসলে আটকে থাকা অর্থ দাঁড়ায় ৫৯৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এ আমানতের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিভিন্ন সময় ট্রাস্ট অর্থ উঠাতে চাইলে দেয়নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুদ-আসলসহ ব্যাংকটির কাছে সংস্থাটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮৭৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর পদ্মা ব্যাংক উল্লেখযোগ্য অনিয়মের কারণে তারল্য সংকটের মুখোমুখি হয়। তারপরও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মতো সরকারি সংস্থাগুলো উচ্চ সুদের প্রলোভন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে পদ্মা ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে।

এ অর্থ উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে গত ১২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপস্থাপন করা হয়। সভায় এ অর্থ নগদায়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আলোচনাপূর্বক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট পথনকশা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল আটকে রয়েছে : পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা ১৭৯ কোটি টাকা ফেরত পেতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা করপোরেশন পদ্মা ব্যাংকে ১০৯ কোটি টাকা জমা করেছিল। ২০১৮ সালের মধ্যে সুদ বেড়ে সেই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৫ কোটি টাকা। তখন থেকে আমানত নগদায়নের জন্য পদ্মা ব্যাংককে ৩১টি চিঠি দিয়েও টাকা ফেরত পায়নি জীবন বিমা করপোরেশন।

২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে পদ্মা ব্যাংকে ৫৩ কোটি টাকা এফডিআর রাখে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটিও বাধ্য হয়ে পদ্মা ব্যাংকের প্রস্তাব অনুযায়ী, ধাপে ধাপে পরিশোধের শর্তে ২০২৯ সাল পর্যন্ত এফডিআর নবায়ন করেছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনেরও (বিটিআরসি) ২৫ কোটি টাকার এফডিআর আটকে আছে এ ব্যাংকে।

পদ্মা ব্যাংক কেলেঙ্কারি : যাত্রা শুরু করার তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আর্থিক অনিয়মের জন্য আলোচনায় আসে পদ্মা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ অনিয়মের মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়, যার বড় অংশ এখন খেলাপি।

এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিস্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত দুজন ২০১৭ সালের নভেম্বরে পদত্যাগে বাধ্য হন।

২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারে তৎপর হয় সরকার। এর অংশ হিসাবে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ৭১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ব্যাংকটির ৬০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। তবে বিনিয়োগের পর থেকে ব্যাংকটি ক্রমাগত লোকসান করায় রাষ্ট্রায়ত্ত এসব প্রতিষ্ঠানও বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো লভ্যাংশ পায়নি। উলটো এসব অর্থের বিপরীতে আমানতকারীদের সুদ পরিশোধ করছে বিনিয়োগকারী তিন ব্যাংক ও আইসিবি।

Related Articles

Back to top button