নতুন বই ছাপা বাঁধাইয়ে ব্যস্ততা বাংলাবাজারে

অনলাইন ডেস্ক: আরও একটি বছর বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। দুয়ারে কড়া নাড়ছে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ। নতুন বছরে নতুন বই উঠবে শিক্ষার্থীদের হাতে। বাতাসে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ ছড়াবে। সে ঘ্রাণে মাতোয়ারা হবে খুদে শিক্ষার্থীরা। বছরান্তে সেসব বইয়ের ছাপা-বাঁধাইয়ের কাজেই ব্যস্ত এখন রাজধানীর বাংলাবাজারের প্রেসপাড়া। ছাপাখানাগুলোয় দিন-রাত পুরোদমে চলছে বই ছাপানো-বাঁধানোর কাজ। দম ফেলার ফুরসত নেই মুদ্রণ ও বাঁধাইকর্মীদের। নতুন বছর সামনে রেখে এমনই কর্মযজ্ঞ চলছে ছাপাখানাগুলোয়।

সরেজমিন বাংলাবাজারের বিভিন্ন ছাপখানা ও বাঁধাইঘর ঘুরে এমন ব্যস্ত চিত্র দেখা গেছে। শুধু নতুন বই ছাপানোই নয়, নতুন বছরের বর্ষপঞ্জি, ডায়েরি, নোট, গাইড ছাপানোর কাজও চলছে পুরোদমে। মুদ্রণযন্ত্রের কর্মীরা বইয়ের পৃষ্ঠা প্রিন্ট করার কাজ করছেন। মুদ্রণযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে ছাপানো কাগজের বড় শিট। এগুলো বাঁধাই করতে মাথায় করে বাঁধাইঘরগুলোয় নিয়ে যাচ্ছেন পুস্তক শ্রমিকরা। এরপর বাঁধাইকর্মীরা দুই হাতের কলাকৌশলে বাঁধাই করে বইয়ের আকৃতি দিচ্ছেন। বাঁধাইয়ের পর সেগুলোয় প্রচ্ছদ লাগিয়ে প্রকাশনী ও লাইব্রেরিতে পাঠানো হচ্ছে।

জামান ব্রাদার্স বাইন্ডিং হাউজের বাঁধাইকর্মীরা যুগান্তরকে জানান, এখন ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ চলছে। খাওয়া-বিশ্রামেরও সময় নেই। নতুন বইয়ের পাশাপাশি নোট-গাইডের কাজও করছেন তারা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেনের বইও ছাপা-বাঁধাই হচ্ছে। যখন কাজ থাকে না, তখন তাদের কষ্টে দিন কাটাতে হয়।

এখন বছরের শেষপ্রান্তে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে আসা বইয়ের কাজ নিয়েই সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা তাদের। তবে বোর্ডের বইয়ের জন্য নিরলস পরিশ্রম করলেও ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। পুস্তক বাঁধাই শ্রমিক নেতা বিপ্লব খান বলেন, সব কাজ আমাদের মতো শ্রমিকদের দিয়েই করানো হচ্ছে; কিন্তু কাজের উচ্চ পারিশ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে দরপত্র হাতিয়ে নেওয়া একটা সিন্ডিকেট। এমন কিছু লোক বইয়ের দরপত্র নিয়ে যাচ্ছে, যারা জীবনে কখনো বাঁধাইশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তারা শুধু মধ্যস্থতা করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এতে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের মতো শ্রমিকরা, হুমকির মুখে পড়ছেন আমাদের মালিকরা, যারা সারা বছর ভর্তুকি দিয়ে শ্রমিকদের কাজে নিয়োজিত রাখে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন প্রিন্টার্স ও পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারীরা বলেন, সরকারি কোনো কাজ আমরা দীর্ঘ ১৭ বছর পাই না। কিন্ডারগার্টেন, বিভিন্ন সাহিত্যের বই ছাপিয়ে কোনো রকমে চলছে আমাদের কার্যক্রম। তবে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিভিন্ন গাইড বইয়ের কাজে ব্যস্ততা বেড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বোর্ড বইয়ের কাজ এ বছরও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান খান কচি বলেন, সারা বছর শ্রমিকদের আমরা মজুরি দিয়ে রেখেছি। এখন বছরের শেষপ্রান্তে যখন কাজ করার সুযোগ এসেছে, তখন হঠাৎ করে একটা চক্র সব শ্রমিক নিয়ে ঘরের ভেতর কাজ করাচ্ছে অল্প পারিশ্রমিকে। তারা সরকারি বোর্ড বই ছাপানোর সব কার্যক্রম উচ্চমূল্যে হাতিয়ে নিয়েছে এবং শ্রমিকদের কম মজুরি দিচ্ছে। যারা সরকারি বোর্ড বইয়ের কাজ দরপত্রের মাধ্যমে নিয়েছে, বাস্তবে তারা কখনোই বাঁধাই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমরা যারা মূলধারার বাঁধাই শ্রমিক, তারা অতীতেও বঞ্চিত ছিলাম, এখনো বঞ্চিত আছি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সালমান এফ রহমান সরকারি বোর্ড বইয়ের মুদ্রণ, বাঁধাইয়ের হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ একাই নিয়ে যেতেন, সরকারি কোনো কাজই আমরা সরাসরি পেতাম না। অথচ আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিবন্ধিত একটা সংগঠন। নীতিমালায় রয়েছে যার কাজ, শুধু তাকে দিয়েই করাতে হবে। যেমন মুদ্রণের কাজ, শুধু মুদ্রণ শ্রমিকরাই করবে। বাঁধাইয়ের কাজ, শুধু বাঁধাই শ্রমিকরাই করবে। কিন্তু বাস্তবে একজনেই মুদ্রণ, প্রকাশ ও বাঁধাইয়ের কাজ করানো হচ্ছে, এক ছাদের নিচে। কাগজ ক্রয়ও তারাই করছে। এর ফলে টাকা মারার কিংবা লুটপাটের বড় একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক জায়গায় নিুমানের কাজ করে, উচ্চমূল্যের বাজেট নিচ্ছে। অদক্ষ বাঁধাইকর্মীদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে, যার ফলে মাস তিনেকের মধ্যেই বই ছিঁড়ে যাচ্ছে। এতসব অপকর্ম ও চক্রান্তের মধ্যেও আমরা চাই ১ জানুয়ারির মধ্যেই সারা দেশে ছাত্রছাত্রীদের হাতে নতুন বই উঠুক। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নতুন সরকার যেন কোনো ধরনের সমালোচনায় না পড়ে, সেদিকে আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা থাকবে। তবে সরকার যদি যার কাজ তাকে বুঝিয়ে দিত, তাহলে খরচ আরও কম পড়ত এবং বইয়ের মানও ভালো হতো।

Related Articles

Back to top button