নিয়োগ বাণিজ্যে ওস্তাদ, দখলেও পটু এনামুল

অনলাইন ডেস্ক: এনামুল হক, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক এমপি। এলাকায় এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে নিয়োগ বাণিজ্যের ভাগ তিনি পাননি। বিদ্যুৎ প্লান্টের কথা বলে জমি নিয়ে কৃষকদের টাকা দেননি। প্রতিপক্ষের জমি দখল করে গড়েছেন মার্কেট। জড়িয়েছেন একাধিক নারী কেলেঙ্কারিতে। বাগমারায় এনামুলকে সবাই নিয়োগ বাণিজ্যের ওস্তাদ এবং দখলের পাকা খেলোয়াড় হিসেবে চেনেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর এনামুল হকের বিরুদ্ধেও আন্দোলনে হামলার অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন এনামুল।

স্থানীয়রা জানান, এনামুল হকের শৈশব কেটেছে দরিদ্র পরিবারে। পড়ালেখার খরচ পর্যন্ত অন্যরা জোগাতেন। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে বেসরকারি একটি কোম্পানিতে কিছুদিন চাকরি করেন। পরে চাকরি ছেড়ে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। এক পর্যায়ে ‘এনা প্রপার্টিজ’ নামে কোম্পানি খুলে ব্যবসা বড় করেন। ২০০৮ সালে নৌকার মনোনয়নে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এনামুল। এর পরই বদলে যায় তাঁর ধনসম্পদের হিসাব।

২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে হলফনামায় এনামুল ১১ ব্যাংকে ঋণ দেখান ৩৭ কোটি টাকার বেশি। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দেওয়া হলফনামায় তা শূন্য উল্লেখ করেন। ২০০৮ সালে কোনো গাড়ি না থাকলেও এখন নিজের নামে প্রায় ২ কোটি ১৩ লাখ টাকার একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ হার্ড জিপ, ৯০ ও ৬৩ লাখ টাকার দুটি টয়োটা হার্ড জিপ এবং স্ত্রীর নামে রয়েছে ১২ লাখ ৭০ হাজার টাকার টয়োটা জিপ। সব মিলে ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক এনামুল হক। অভিযোগ রয়েছে, মাত্র পাঁচ বছরে এত অর্থ এনামুল হক কামিয়েছেন নিয়োগ ও মনোনয়ন বাণিজ্য, জমি দখল, দলীয় পদ-পদবি বিক্রির মাধ্যমে।

কারাগারে থাকায় এনামুল হকের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর ছোট ভাই বাগমারার মাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল হক লেদা সমকালকে বলেন, ‘আমার ভাই এনামুল হকের নিয়োগ বাণিজ্যের সাক্ষী আমি নিজে। স্কুল-কলেজ থেকেই তিনি অন্তত ১৫০ কোটি টাকা কামিয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তিনি কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।’ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘কিছু অর্থ ব্যবসা থেকে এসেছে, সত্য। তবে অধিকাংশ টাকা অবৈধভাবে অর্জিত। তিনি আমার বড় ভাই হলেও সত্য বলতে হবে। একজন মানুষের টাকা হতেই পারে। কিন্তু এত অল্প সময়ে বৈধভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা কীভাবে সম্ভব?’

নিয়োগ বাণিজ্যে ওস্তাদ

বাগমারা উপজেলায় ২৩৪টি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে। গত ১৫ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কমিশন হিসেবে এনামুল হক পেয়েছেন অন্তত ৪০০ কোটি টাকা। তাঁর নিয়োগ বাণিজ্যের মধ্যস্থতা করতেন ব্যক্তিগত সহকারী মোল্লা আলতাফ হোসেন। আলতাফ ছাত্রশিবির থেকে একসময় জেএমবি নেতা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাইয়ের সহযোগী হন। পরে ২০০৮ সালে এনামুলের হাত ধরেই আসেন আওয়ামী লীগে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা নিতেন এনামুল। প্রেস সচিব জিল্লুর রহমান সমন্বয় করতেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত ৭০ নৈশপ্রহরী-কাম দপ্তরি নিয়োগে জনপ্রতি এনামুল ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা নিয়েছেন।

ভবানীগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইয়াদ আলী বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করা মেয়ের জন্য এনামুল হককে ৫ লাখ টাকা দিই। চাকরি তো হয়ইনি, টাকাও পাইনি। চাইলে বলতেন, কলেজ ফান্ডে জমা দিয়েছি। পরে জেনেছি, জমা না দিয়ে মেরে দিয়েছেন তিনি।’

জমি দখলে পটু

ভবানীগঞ্জে প্রায় ৩০ শতক জমি দখল করে একাংশে বোনজামাই নাদেরুজ্জামান আলমকে বাড়ি করে দিয়েছেন এনামুল। অন্য অংশ এখন টিনে ঘেরা। এ জমির মালিক বাগমারা উপজেলা বিএনপি নেতা কামাল হোসেনের দাবি, ১৪ বছর আগে প্রভাব খাটিয়ে দখল নেন এনামুল হক। নানার কাছ থেকে মা, পরে উত্তরাধিকার সূত্রে আমি জমির মালিকানা পাই। জমির পাশে একটি সরকারি খাস পুকুর ও ভবানীগঞ্জ বাজারের সরকারি জমি দখল করে সেখানে নিউমার্কেট নির্মাণ করেন এনামুল। পরে দোকানের পজেশন কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করেন।

মড়িয়া ইউনিয়নের সূর্যপাড়া গ্রামের প্রায় ২৫ কৃষকের সাড়ে ১৬ বিঘা জমি এনামুল হক দখল করেন ২০২২ সালে। জমিতে সরকারি বিদ্যুৎ প্লান্টের কথা বললেও, কাউকে টাকা দেননি। কৃষকরা জমি দিতে রাজি না হলে এনামুল হক ছোট ভাই রেজাউল হক লেদার মাধ্যমে কৃষকদের নামে চাঁদাবাজি ও ভাঙচুরের মামলা করান।

মাড়িয়া ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন মালা মেম্বার এবং সূর্যপাড়া গ্রামের চাষি জনাব আলী বলেন, ক্যাডার নিয়ে এসে ২৫ কৃষকের জমি দখল করেন এনামুল। আমাদের কোনো চাষি জমির টাকা পাননি। আপত্তি করায় উল্টো ৩৬ জনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও ভাঙচুর মামলা দেন লেদা। এ মামলায় অনেককে জেল খাটতে হয়েছে।
এ বিষয়ে রেজাউল হক বলেন, ‘চীন-বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার গ্রিড ১৩২-৩৩ কেভি হচ্ছে। কিন্তু কৃষকরা জমি দেবেন না। বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে মারামারি হয়। পরে কৃষকদের নামে মামলা করি।’ বিএনপি নেতা কামাল হোসেনের জমি দখলের কথাও স্বীকার করেন তিনি।

বিক্রি করতেন দলীয় পদ-পদবি

দলীয় পদ-পদবি পেতেও টাকা দিতে হতো এনামুলকে। গত সম্মেলনে বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন এনামুল হক। সাধারণ সম্পাদক করতে গোলাম সারওয়ার আবুলের কাছ থেকে তিনি ২০ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলীয় প্রতিটি পদের জন্যই এনামুল টাকা নিয়েছেন বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগমারার এক নেতা বলেন, এনামুলকে টাকা দিলেই মিলত আওয়ামী লীগের পদ-পদবি। এভাবেই তিনি জেএমবি নেতা আবদুস সালাম, সর্বহারা ক্যাডার আবদুর রাজ্জাক ওরফে আর্ট বাবুসহ অনেককে আওয়ামী লীগের পদে বসিয়েছেন। এর মধ্যে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আলো খন্দকারসহ অন্তত ১৫ হত্যা মামলার আসামি আর্ট বাবুকে উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি করেছেন। গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছিলেন। আর্ট বাবু সার্বক্ষণিক সর্বহারা ক্যাডারদের নিয়ে এনামুলের নিরাপত্তায় থাকতেন।

উপজেলার প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এনামুলের বিরুদ্ধে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে গোয়ালকান্দি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এনে দেন সাবেক তালিকাভুক্ত জেএমবি ক্যাডার আবদুস সালামকে। পরে বিষয়টি নিয়ে সমকালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বহিষ্কার করেন আবদুস সালামকে। নেতাকর্মীর অভিযোগ, সব নির্বাচনেই এনামুল মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। টাকা বেশি দিলেই তাঁকে দলীয় মনোনয়নের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

নারী কেলেঙ্কারি

এমপি থাকার সময় একাধিক নারীর সঙ্গে এনামুল হকের অডিও-ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে তাঁকে প্রকাশ্যে অশালীন আলাপ করতেও দেখা যায়। রাজশাহী শহরের এক নারীকে বিয়ে করে কয়েক বছর গোপনে সংসার করেন এনামুল। পরে স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ্যে আনার দাবি জানালে তাঁকে তালাক দেন। এ ঘটনায় ওই নারী সংবাদ সম্মেলন করে এনামুল হকের বিচার চান। পরে প্রভাব খাটিয়ে ওই নারীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে জেলে পাঠান তিনি। সূত্র: দৈনিক সমকাল

Related Articles

Back to top button