আগা খান, গোড়াও খান তিনি শাজাহান খান
অনলাইন ডেস্ক: সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একক আধিপত্য, জমি দখল, কমিশন-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি- আওয়ামী শাসনামলে এসবই ছিল মাদারীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি শাজাহান খানের পুঁজি। শ্রমিক নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও টানা আটবারের এই সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল জেলার সব খাত ও প্রতিষ্ঠান। সব খাতেই ছিল তার কমিশন-বাণিজ্য। হলফনামার তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি ছিলেন দেনাদার। আর ২০১৮ সালের গোয়েন্দা সংস্থার একটি গোপন প্রতিবেদনমতে, ১০ বছরে তিনি হয়েছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। বিগত ১৫ বছরে তার আয় বেড়েছে ৩২ গুণ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি ও তার পরিবার আত্মগোপনে চলে যান। ৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাজাহান খানকে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দর থেকে তার ছেলে আসিবুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আওয়ামী শাসনামলে মাদারীপুর জেলার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ছিল শাজাহান খান ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। শুধু মাদারীপুরেই নয়, সারা বাংলাদেশে তার ছিল দুর্দান্ত নেটওয়ার্ক। এক সময় ছিলেন জাসদ নেতা। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘খান-লীগ’। তার এই ক্যাডার বাহিনী এবং পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের দাপটে দলের নেতাকর্মীরাও ছিলেন অতিষ্ঠ। ২০১৩ সালে তিনি গড়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ। ২০১৯ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। এ সময় তার বিরুদ্ধে অমুক্তিযোদ্ধাদের টাকার বিনিময়ে সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
২০১৫ সালে গড়ে তোলেন শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ। গত জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে তিনি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মিলে গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্ম সমন্বয় পরিষদ।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা মোতাবেক শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬ টাকা। সে হিসেবে তার মাসিক আয় ছিল ৫৭ হাজার ৮৬ টাকা। তার স্ত্রীর শিক্ষকতা থেকে মাসে আসত পাঁচ হাজার দুইশ টাকা। তখন তাদের (স্বামী-স্ত্রী) হাতে নগদ কোনো টাকা ছিল না। বরং ঋণ ছিল ৪২ লাখ টাকার ওপরে। ২০০৮ সালে তার নিজ নামে স্থাবর সম্পদ ছিল তিন স্থানে। এ ছাড়াও গ্রামের বাড়িতে যৌথ মালিকানায় স্থাবর সম্পদ ছিল। বর্তমানে সাবেক এই নৌমন্ত্রীর নিজ নামে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে কমপক্ষে ১৫ স্থানে এবং যৌথ মালিকানায় রয়েছে আরও ছয় স্থানে। ১০ বছর আগে নৌমন্ত্রীর স্ত্রীর নামে ছিল দুই স্থানে স্থাবর সম্পদ। বর্তমানে তার স্ত্রীর নামে স্থাবর সম্পদ আছে ১৩ স্থানে।
দলীয় ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালে ছাত্ররাজনীতি দিয়ে শাজাহান খানের হাতেখড়ি। দেশ স্বাধীনের পর জাসদ গঠন হলে তিনি জাসদে যোগ দেন। জাসদের সশস্ত্র সংগঠন গণবাহিনীরও সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রথমবারের মতো এমপি হন তিনি। পরে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এরপর দ্রুতই তার ভাগ্য বদলে যায়। শাজাহান খান, তার ভাই এবং তার অনুগত দলীয় ক্যাডাররা একে একে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন বিভিন্ন সেক্টরে। পরে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হন তিনি। তখন সংগঠনটির বিরুদ্ধে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলেও প্রশাসনের ভূমিকা ছিল নীরব। তার পরিবারের সদস্য ও অনুগত ক্যাডাররা সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডারবাজি করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বিগত সরকারের আমলে। তার ছোট ভাই হাফিজুর রহমান খান (যাচ্চু) মাদারীপুরের বিভিন্ন দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। আরেক ভাই ওবায়দুর রহমান খান ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি। তার ইশারায় চলত মাদারীপুরের বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগে সিন্ডিকেট করে তিনি কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
শাজাহান খানের মালিকানাধীন সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে রয়েছে সার্বিক পরিবহন, সার্বিক ফিলিং স্টেশন, সার্বিক কনস্ট্রাকশন ফার্ম, সার্বিক রিয়েল স্টেট, সার্বিক ইটভাটা, সার্বিক প্রেসসহ নানাবিধ ব্যবসা। সবই তিনি করেছেন দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে। মাদারীপুর শহরের একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার ভাই ওবায়দুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। সড়ক বিভাগের জমি দখল করে ফিলিং স্টেশন নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তার ছোট ভাই হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। শুধু জমি দখল নয়- এলজিইডি, সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সব সরকারি দপ্তরের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শাজাহান খান তার ক্ষমতার দাপটে মাদারীপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চেম্বার অব কমার্সও দখলে নিয়েছিলেন। মাদারীপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে নিজেই সভাপতির পদ দখল করেন। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে বসান তার বন্ধু সৈয়দ আবুল বাসারকে। চেম্বার অব কমার্সের দায়িত্ব দেন ছোট ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চুকে। এসব দখল করেই ক্ষান্ত থাকেননি। তিনি নৌমন্ত্রী থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের স্মারক নম্বর ব্যবহার করে মাদারীপুর প্রেসক্লাব দখল করেন। প্রেসক্লাবের দায়িত্ব দেন তার বন্ধু শাহজাহান খানকে। এভাবেই তিনি মাদারীপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করেন।
১৯৭০ সালে মাদারীপুর সদরে একটি মামলায় শাজাহান খানের ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জ সদর থানার একটি অস্ত্র মামলায় তার বিরুদ্ধে ৫ বছরের সশ্রম কারাদ-ের আদেশ হয়। তা ছাড়া ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সর্বহারা ও জাসদের একাধিক নেতাকর্মীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তবে কোনো ঘটনাতেই তার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পায়নি কেউ। আর দায়ের হওয়া মামলাতেও তাকে কখনো জেলহাজতে যেতে হয়নি। সব সময়ই তিনি ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ২০১৩ সালে খালেদা জিয়ার বাসার বিদ্যুৎ লাইন ও পানির লাইন কেটে দিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনায় আসেন।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পি কয়েক বছর আগে জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে শাজাহান খানের অমতে অংশ নেন। শাজাহান খান এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার অনুসারীদের দিয়ে সুজিতকে শারীরিক নির্যাতন এবং নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করেন। সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘শাজাহান খান ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন মানুষকে হয়রানি করেছেন। আমাকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন। তিনি অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আমরা চাই দুদক বিষয়টি তদন্ত করুক। শাজাহান খানের বিচার হোক।’
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে বলেন, ‘শাজাহান খান আওয়ামী লীগ করেন নাই, করেছেন ‘ব্যক্তি-লীগ’। একক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দমন-পীড়ন করেছেন। যা নিয়ে বহু বছর ধরেই জেলার নেতাদের সঙ্গে তার বিভেদ ও দ্বন্দ্ব লেগে ছিল।’ সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়