সবচেয়ে দুর্বল আর্থিক খাতের জের টানতে হচ্ছে, মেগা প্রকল্প ছিল মূলত ‘ভ্যানিটি প্রকল্প’

অনলাইন ডেস্ক: দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে বিনিয়োগ আসবে না। আর বিনিয়োগ না হলে তার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ প্রয়োজন। সোমবার (১১ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত ‘তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন-২০২৪’ এ অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এ কথা বলেন।

এই আয়োজনের বিষয় ছিল ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিভিন্ন সেশনে বক্তব্য দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল আউয়াল মিন্টুসহ আরো অনেকে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্র-জনতা আমাদের কিছু দায়িত্ব দিয়েছে। সেটুকু আমরা যথাসম্ভব পালন করার চেষ্টা করছি। আমাদের কারো কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই। এজেন্ডা হচ্ছে দেশের স্বার্থ। যা কিছু করা হচ্ছে তা দেশের স্বার্থেই করা হচ্ছে। আর আমরা যা করছি সেটি ভবিষ্যতে যে কোনো সরকার এলেও তারা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা কাজগুলোকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছি। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কাজ। আমরা হয়তো মধ্যমেয়াদি কাজ শুরু করতে পারব। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলো পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারে যারা আসবেন তারা করবেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ বৈষম্যের ক্ষেত্রে দুটি দিক রয়েছে। যার একটি চোখে দেখা যায় না এবং আরেকটি দেখা যাচ্ছে। আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি, আয় ও সম্পদের বৈষম্যও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আবার আয়ের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য বেশি প্রকট।

গরিব মানুষ সুযোগের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, গ্রামের অনেক মানুষই জানেন না সরকারি সুযোগগুলো কোথায় পাওয়া যাবে। তারা সুযোগের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রেও বৈষম্য হচ্ছে। গরিব মানুষকে শুধু ভিটামিন এ ক্যাপসুল আর কলেরার টিকা দিলেই হয় না। তারও মরণব্যাধিও হয়। কিন্তু তার জটিল রোগের চিকিৎসা কোথায় করাবে সেটি নির্দিষ্ট নয়। তাকে ঘটিবাটি বিক্রি করে ঢাকা আসতে হচ্ছে। আবার শিক্ষা খাতেও অনেক সময় তারা গুণগত শিক্ষা পান না।

খরচ কমিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে উল্লেখ করেছেন বাণিজ্য, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেন, রাজনীতির ব্যবসায়িকীকরণ যেভাবে করা হয়েছে মাঝে মাঝে ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেও দ্বিধা হয়। তবে শিগগিরই খরচ কমিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

বাংলাদেশে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা হবে না:গভর্নর

সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা হবে না, দুর্ভিক্ষ হবে না, কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। কিন্তু দেশে প্রবৃদ্ধির গতি যে কমে গেছে, তা অনিবার্যই ছিল। তিনি আরো বলেন, আমরা কি শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছি, অবশ্যই না; আমাদের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি; অর্থনীতিও ধসে পড়েনি। হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের চেষ্টা করছে।

এ বাস্তবতায় দেশে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে যাবে বলে মন্তব্য করেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, কিছু ব্যাংকে পুঁজি সঞ্চার করা হবে, কিছু ব্যাংকে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসতে হবে। এসব করার জন্য আইনি কাঠামো প্রয়োজন; সেই কাজ এখন করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের সম্পদের মান পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংকিং খাত, এই মন্তব্য করে আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, দেশের আর্থিক খাত সবচেয়ে দুর্বল, এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও। আর্থিক খাতের এই দুর্বলতার ছাপ দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে। তার জের টানতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যে এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎমুখী কিছু করা সম্ভব হয়নি বরং অতীতের জের টানা ও সংশোধনমূলক কাজ করতে হচ্ছে আমাদের। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে বিনিয়োগ আসবে না। দেশের মূল্যস্ফীতি কমাতে আরো পাঁচ-ছয় মাস সময় প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

গভর্নর বলেন, ব্যাংকের টাকা যারা দেশের বাইরে নিয়ে গেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি মাসে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ, বিশ্বব্যাংক, ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা দেশে আসবেন। কীভাবে আইনগতভাবে অর্থ ফেরত আনা যায় তাদের সঙ্গে সেই আলোচনা হবে।

গত তিন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো টাকা ছাপায়নি উল্লেখ করেন তিনি বলেন, আমরা টাকা না ছাপিয়েই তারল্য সংকট সমাধান করছি। এ সময় তিনি বেক্সিমকো গ্রুপে রিসিভার নিয়োগের বিষয়ে বলেন, কয়েক মাস ধরে তাদের শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছিল না। সরকারি অর্থ দিয়ে তাদের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। এখন গ্রুপটিতে রিসিভার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাতে গ্রুপটি (বেক্সিমকো) সচল করা যায়। তাদের বন্ধ করা নয় বরং সচল রাখতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ক্ষমতায় গেলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ করে বরাদ্দ করব: আমীর খসরু

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দেবে উল্লেখ করে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের ‘আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার’ আফগানিস্তানের চেয়েও বেশি।
বিগত সরকারের বাজেট বরাদ্দ ভুল হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরাদ্দ গেছে মেগা প্রকল্পে, এজন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ হয়নি। ক্ষমতায় গেলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আলাদাভাবে জিডিপির পাঁচ শতাংশ করে বরাদ্দ করা হবে।

বিগত সরকার বিদ্যুৎ সেক্টরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এর প্রভাব দেশের মানুষকে বইতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ত্রর্যক্ষমতা কমে গেছে। অর্থনীতিকে গণতন্ত্রায়ন করতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতির মধ্যে পড়তে হবে।
এ সময় রাজনৈতিক জবাবদিহির অভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে চান। কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ আশা করেন।

দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে, তবে কাজের গতি কমে গেছে: হোসেন জিল্লুর

মাঠ পর্যায়ে অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষ বলছে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দৃশ্যমান দুর্নীতি কমেছে, তবে কাজের গতি কমে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকায় বসে আছে, মাঠে যেতে দেখলাম না। মাঠে যাওয়া খুব দরকার।

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বৈষম্য বহুমাত্রিক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ একটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে। শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনীতি থেকেও প্রতিযোগিতা হারিয়ে গেছে। চারটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য, বিনিয়োগবান্ধব, সাম্প্রতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ সবার কর্মসংস্থান ও মুদ্রাস্ফীতি কমানো। বর্তমান গভর্নর সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মেগা প্রকল্পের সমালোচনা করে তিনি বলেন, অনেক প্রকল্প যাচাই-বাছাই ছাড়া বাস্তবায়ন করা হয়েছে যার ফলে এর থেকে অর্থনৈতিক সুফল তেমন নেই। এগুলোকে মেগা প্রকল্প না বলে ‘ভ্যানিটি প্রকল্প’ বলা যায়।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, আমাদের দেশে বিনিয়োগ করে দেশেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের সমাজে বহুমাত্রিক বৈষম্য বিদ্যমান। আইন প্রয়োগে বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্যসহ সব ধরনের সামাজিক বৈষম্য আমাদের সমাজে বিদ্যমান। সম্পদ বৃদ্ধি করে বৈষম্য কমানো সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।

মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে, চৌধুরী বলেন, বিগত ১৫ বছরে দেশে রিফাইনারি খাতে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। তিনি বেসরকারি খাতে জ্বালানি আমদানি করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিং, ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি, ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাভেদ আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা।

Related Articles

Back to top button