জাল দলিলে জালিয়াতি

অনলাইন ডেস্ক: চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকার পাঁচ গণ্ডা জমি বেচাকেনার সব নথি প্রস্তুত। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জমির মালিক ও ক্রেতা উভয়েই হাজির হন পাহাড়তলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। শুধু সাব-রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর করলেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। হঠাৎ জমির মালিকের কাছে নানা তথ্য জানতে চান রেজিস্ট্রার। ঘাবড়ে গিয়ে এলোমেলো উত্তর দেন কথিত মালিক মো. আলী। পরে জেরায় স্বীকার করেন, তিনি জমির প্রকৃত মালিক নন– তাঁকে মালিক সাজিয়ে আনা হয়েছে। এভাবেই একজনের জমি হয়ে যাচ্ছিল অন্যের। তবে নকল বিক্রেতা-ক্রেতা সেজে যার জমি বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছিল, সেই জমির আসল মালিক আবদুর রশিদ মিয়া এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এ ঘটনার মতো অভিনব কায়দায় জাল দলিল দিয়ে অন্যের জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন নগরের চৌমুহনী এলাকার বাসিন্দা মুরাদ মিয়া। নগরের বেপারিপাড়া এলাকায় নশা মিয়া সওদাগরের জমি দেখাশোনা করতে গিয়ে একটা সময় পর নিজেই বনে যান মালিক। মূল মালিককে অন্ধকারে রেখে এই জালিয়াতি করেন তিনি। ঘটনা জানার পর নশার জামাতা মো. ইলিয়াস গত বছর চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করেন। সেই মামলায় জাল দলিলে জমি আত্মসাতের প্রমাণ পেয়ে চার্জশিট দেয় পুলিশ। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর গত ১১ মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয় তাঁকে।

একইভাবে ভুয়া দলিলে জীবিতকে মৃত, মৃতকে জীবিত দেখিয়ে জমি হাতিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে সিআইডি। ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি আদালতে মামলা করেন নগরের পূর্ব বাকলিয়ার বাসিন্দা বৃদ্ধা শহর মুল্লক। তাঁকে মৃত দেখিয়ে তাঁর জায়গা জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন কোতোয়ালির বাসিন্দা এস এম আহমদ হোসাইন। সিআইডি তদন্তে পায়, গরিব ভূমি মালিকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে মৃত এক নারীকে জীবিত এবং জীবিতকে মৃত দেখিয়ে আমমোক্তারনামা ও সাফকবলা দলিল রেজিস্ট্রি করে নেন হোসাইন। জমি হাতাতে প্রতিবন্ধী আকবর হোসেনকে সাজানো হয় দাতা।

চট্টগ্রামে এভাবে আসল জমির মালিককে অন্ধকারে রেখে একজনের জমি অন্যের নামে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। আর এ জালিয়াতি ও প্রতারণা ঘটছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও চান্দগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ঘিরেও ঘটছে এই জালিয়াতি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব অফিস ঘিরে সক্রিয় থাকা জালিয়াত চক্র সাব-রেজিস্ট্রারদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করেন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কিছু রেকর্ডকিপার ও নকলনবিশ।

প্রতারণার শিকার ভূমি মালিক আবদুল মোমেন বলেন, আমার বিশাল সম্পত্তি ভুয়া ব্যক্তি ও ভুয়া বিএস খতিয়ান বানিয়ে হাতিয়ে নেয় ভূমিদস্যুরা। আমি কিছুই জানি না। পরে আত্মসাতের ঘটনা জানতে পেরে মামলা করার পর পিবিআই পুরো জালিয়াত চক্রকে শনাক্ত করে। এ অপকর্মে রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মকর্তারাও জড়িত।
বেশ কয়েকটি আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রো পিবিআই ইন্সপেক্টর এনামুল হক। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে একটি মামলার তদন্ত করতে জমির মালিক রেজিস্ট্রিদাতা নারীর ঠিকানায় গিয়ে ওই নারীর কোনো অস্তিত্ব পাইনি। বিএস খতিয়ানে ভুয়া ব্যক্তির নাম ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে বসিয়ে জমির মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। আরও কয়েকটি মামলার তদন্তে এমন প্রমাণ পেয়েছি।
সিনিয়র আইনজীবী রাশেদুল ইসলাম সুমন বলেন, সাব-রেজিস্ট্রাররা চাহিদামতো ঘুষ পেলে খুব বেশি যাচাই-বাছাই না করেই জমি রেজিস্ট্রি করায় জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। তারা
দাতা-গ্রহীতার এনআইডি পর্যন্ত যাচাই করে দেখেন না। তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় ঘিরে দুষ্টচক্র সক্রিয়। তারা ভুয়া দলিল জালিয়াত ও ভূমিদস্যুর সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন। এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে আসল দলিলের লেখা তুলে ফেলে নতুন দলিল লেখা হয়। তারপর টাকার বিনিময়ে সেসব দলিল দিয়ে নামজারি ও দখলকারীদের সরবরাহ করা হয়। ওই চক্রটির কাছে মজুত রয়েছে সরকারি পুরোনো স্ট্যাম্প, জাল দলিল করার উপকরণ, রেজিস্ট্রার ও ভূমি অফিসের সিল। এ জালিয়াত চক্রে রয়েছেন আনোয়ারার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম, আবদুল ছালাম, লোকমান, আইয়ুব আলী, শাহ আলম, ওমর গণি, জয় কান্দি দে, তারেক, সুলতান, আরিফ, তোফায়েল, আরিফুল ইসলাম, তারেক, সুলতান ও রনি। আর তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ডকিপার ও নকলনবিশ।
চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার মিশন চাকমা বলেন, অর্থের জরুরি প্রয়োজনে মানুষ জমি বিক্রি করে রেজিস্ট্রি করে। আমরা মূলত দলিল, তার সঙ্গে থাকা এনআইডি, শনাক্তকারী, ছবিসহ তথ্য-উপাত্ত যাচাই করেই রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করি। অর্থের বিনিময়ে নয়, অসাবধানতাবশত দু-একটি একজনের জমি অন্যজন মালিক সেজে রেজিস্ট্রি করার ঘটনা ঘটেছে।

Related Articles

Back to top button