রাশিয়ায় নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশিদের

পুলিশের সিআইডির (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) মানব পাচার সেল জানিয়েছে, ঢাকাভিত্তিক সংস্থা ড্রিম হোম ট্রাভেল গত দুই বছরে প্রায় ২০ জন বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাচার করেছে বলে তথ্য পেয়েছে তারা

অনলাইন ডেস্ক: চাকরি ও উন্নত জীবনের আশায় শত শত তরুণ পাড়ি জমাচ্ছে রাশিয়ায়। মস্কোর শপিং মলে সেলসম্যান, সিকিউরিটি গার্ড, রেস্টুরেন্টে শেফসহ বিভিন্ন পদে মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে তাদের। দুই-তিন বছর চাকরি করার পর নাগরিকত্ব প্রদান এবং এর পাশাপাশি বাবা-মা, ভাই-বোনকেও রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়া হবে—এমন আশ্বাসও মিলছে। এমন সব প্রলোভনে পড়ে শত শত বাংলাদেশি তরুণ-যুবক দুবাই, সৌদি আরব অথবা তুরস্ক হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। এক-দুই সপ্তাহ পর তাদের গাড়িতে করে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়িটি পৌঁছে যায় মস্কো থেকে ১০০-১৫০ কিলোমিটার দূরে রাজধানীর বাইরে জনমানবহীন এক এলাকায় অবস্থিত রাশিয়ার একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। তখন বাংলাদেশি তরুণ-যুবকরা বুঝতে পারে তাদের একটি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এরপর শুরু হয় তাদের ‘মোটিভেশনের’ কাজ।

বলা হয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে মাসে চার লাখ রুবল পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। প্রাপ্ত রুবল বাংলাদেশেও রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠাতে পারবে তারা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে তাদের রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবে রাজি না হলে এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাও বন্ধ। অগত্যা জীবনের মায়া ত্যাগ করে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন তারা।

পুলিশের সিআইডির (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) মানব পাচার সেল জানিয়েছে, ঢাকাভিত্তিক সংস্থা ড্রিম হোম ট্রাভেল গত দুই বছরে প্রায় ২০ জন বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাচার করেছে বলে তথ্য পেয়েছে তারা। জানা গেছে, তরুণদের প্রতি মাসে ২ লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ঐ প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে পাঠায় তরুণদের। ওমরাহ করার পর তাদের রাশিয়ার মস্কোতে পাচার করা হয়। মস্কোতে সুলতান নামে বাংলাদেশি এক ব্যক্তির কাছে তাদের বিক্রি করা হয়। সুলতান তাদের রাশিয়ান সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। এই ২০ জনকে সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। যারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাদের ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা। ঐ ২০ জনের মধ্যে তিন জনকে মস্কোর স্থানীয় একটি চক্র ইতিমধ্যে হত্যা করেছে বলে সিআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি তিন থেকে চার জন বাংলাদেশিকে ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। যেহেতু তারা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছিল, তাই তাদের মৃতদেহ ফিরিয়ে আনা এখনো অনেক দূরের বিষয়।’

নিহত চার জন, অনেকের খোঁজ নেই

সিআইডি জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের ২৫ বছর বয়সি আকরাম হোসেনের পরিবার খবর পায় যে, গত ১৪ এপ্রিল আকরাম ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। আকরাম ৯ মাস আগে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন ওয়েল্ডারের কাজ করে তার পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার আশায়।

আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া বলেন, আমরা আত্মীয়দের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা ধার করে আকরামকে রাশিয়ায় পাঠিয়েছিলাম। আকরাম একটি চীনা কোম্পানিতে ছয় মাস ধরে ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ করছিল। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে আকরামকে ‘চুক্তিবদ্ধ যোদ্ধা’ হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। ১৫ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণের পর আকরামকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।

ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ইয়াসিন মিয়া শেখ গত বছর দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেন। ঈদের পর দিন রাশিয়ায় থাকা এক পরিচিতজনের কাছ থেকে পরিবার জেনেছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইয়াসিন নিহত হয়েছেন। মেহেদী হাসানের আইডি থেকে একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এই যে দেখেন বাড়িঘর সব ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। আমরা এখানে কাজ করছি। এই যে রাব্বী, রাব্বী তাকাও, এই যে ইমতিয়াজ ভাই, রায়হান ভাই, ঐ খায়রুল ভাই লুক দেন, ঐ যে ঐখানে ইয়াসিন আছে। সবাই আমরা কাজ করছি।’

নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবীরও নিহত হন। তার ভগ্নীপতি রহমত আলী এখনো রাশিয়ায় আটকে রয়েছেন। পরিবারের দাবি, ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরব নেওয়ার কথা বলে তাদের রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে জোর করে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়।

রহমত আলীর স্ত্রী যমুনা বেগম দাবি করেন, রাশিয়ায় সেনানিবাসে নিয়ে তার স্বামী ও ভাই হুমায়ুনকে জোর করে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করিয়ে ২০ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তারা বারবার তাদের বাঁচানোর আর্তি জানান। তার স্বামীই গত ২৬ জানুয়ারি ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় হুমায়ুনের নিহত হওয়ার খবর পরিবারকে জানান।

যশোরের জাফর হোসেনকে সাইপ্রাসে ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৯ লাখ টাকা নিয়ে সৌদি আরব, দুবাই হয়ে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। তিনি এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আটকা পড়েছেন। প্রাণ নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন পরিবারকে।

রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন রাজবাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। দীর্ঘ সাত মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর গত ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নজরুলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে তার পরিবারকে।

নজরুলের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যরা জানান, স্থানীয় দালাল ফরিদ হোসেন নজরুলকে রাশিয়ার শ‌পিংমলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। এরপর চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে জোরপূর্বক ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় তাকে। পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় গত ৩০ এপ্রিল। সেই দিন নজরুল ফোনে তার স্ত্রীকে জানান, তিনি ব্যাংকে যাচ্ছেন টাকা পাঠাতে। এর কিছুক্ষণ পরই ফের ফোন করে বলেন, ‘আমার আর টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ পেয়ে থাকো তাহলে ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই’। সেটাই ছিল তার শেষ কথা। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের ভিডিও ভাইরাল
রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি তরুণদের ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। যুদ্ধে কীভাবে অংশগ্রহণ করছে তার ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে। ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বিধ্বস্ত ভবনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছেন তারা। জঙ্গল বা ফাঁকা গমখেতের মধ্যে তারা বাংকার খনন করছে। রাস্তায় পড়ে আছে ট্যাংক, সাঁজোয়া যানবাহন, এপিসি, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানসহ যুদ্ধের শত শত সরঞ্জাম। আবার মেশিনগান থেকে শক্রুপক্ষের দিকে মুহুর্মুহু গুলি করা হচ্ছে। এখানে ওখানে পড়ে আছে ভূপাতিত ড্রোন।

Related Articles

Back to top button