বিক্ষোভে বেঞ্চ হারালেন ১২ বিচারপতি
নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র বিক্ষোভের মুখে হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে আগামী রোববার থেকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা গতকাল বুধবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে এসে এ ঘোষণা দেন। এর ফলে আপাতত তারা কোনো বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। দেড় মাস বার্ষিক ছুটির পর আগামী রোববার সুপ্রিম কোর্ট খুলবে। সেদিন থেকেই তারা আর কোনো বেঞ্চ পাবেন না।
এর আগে ‘দুর্নীতিবাজ, দলবাজ ও ফ্যাসিস্টের দোসর’ বিচারকের পদত্যাগ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী আইনজীবীরা গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এ সময় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীদেরও বিক্ষোভে দেখা যায়। পরে রেজিস্ট্রার জেনারেলের ঘোষণা আসার পর আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা ছাড়েন।
রেজিস্ট্রার জেনারেল তাঁর ঘোষণায় কারও নাম উল্লেখ না করলেও সমকাল জানতে পেরেছে ১২ বিচারপতির নাম। তারা হলেন– নাঈমা হায়দার, খুরশীদ আলম সরকার, মো. আতাউর রহমান খান, শেখ হাসান আরিফ, খিজির হায়াত, শাহেদ নূর উদ্দিন, ড. মো. আখতারুজ্জামান, আশীষ রঞ্জন দাস, এস এম মনিরুজ্জামান, খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, মো. আমিনুল ইসলাম ও এস এম মাসুদ হোসেন দোলন।
এর আগে বিক্ষোভের মধ্যেই দুপুর ১টার দিকে হাইকোর্টের ছয় বিচারপতি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। তারা হলেন– শাহেদ নূর উদ্দিন, মো. আখতারুজ্জামান, এস এম মনিরুজ্জামান, খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, মো. আমিনুল ইসলাম ও এস এম মাসুদ হোসেন দোলন। তবে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে বের হওয়ার পর তারা সাংবাদিকদের কিছু বলতে রাজি হননি।
হাইকোর্ট বিভাগের কতিপয় বিচারপতির বিরুদ্ধে আগে থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতিসহ যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি রায়ের ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে।
যা বললেন রেজিস্ট্রার জেনারেল
বিকেল ৪টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, ‘বিচারক অপসারণের কোনো আইন উচ্চ আদালতে এ মুহূর্তে কার্যকর নেই। এ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে যে রিভিউ মামলা রয়েছে, এর শুনানি হবে আগামী রোববার। ওই ১২ বিচারপতি যেহেতু পদত্যাগ করেননি, সেহেতু তাদের অপসারণ করা যাচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আপাতত তাদের কোনো বেঞ্চ দেওয়া হবে না। তারা বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন না।’
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বলেন, ‘আপনাদের যে দাবি, আপনাদের যে লিডার, তারা আমার চেম্বারে বসেছিলেন। আমরা দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। পরে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। আপনারা জানেন, বিচারপতির পদত্যাগ বা অপসারণে একটা আইনি প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ-সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একটা সংশোধনী হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। সেটা আবার সরকার রিভিউ করেছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগে আগামী রোববার সেটি শুনানি হবে। মামলাটি ১ নম্বরে রাখা হয়েছে।’
আজিজ আহমদ ভূঞা আরও বলেন, ‘বিচারপতির নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের সেই উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের, প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয়, উনি সেটা করেছেন। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো, তারা আর বিচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না।’
ঘেরাও কর্মসূচি
এর আগে বুধবার বেলা ১১টা থেকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বিচারকের পদত্যাগ দাবিতে হাইকোর্ট এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। অন্যদিকে হাইকোর্ট বিভাগের ‘দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন বৈষম্যবিরোধী আইনজীবীরা। এতে যোগ দেয় জাতীয় নাগরিক কমিটিও। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপি ও জামায়াতের আইনজীবীরা।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট চত্বরে আসেন শিক্ষার্থীরা। সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দক্ষিণ গেট দিয়ে ঢুকে তারা হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন। সঙ্গে ছিলেন আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম।
কর্মসূচিতে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিস্ট বিচারপতিদের অপসারণ দাবির পাশাপাশি ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সারাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারক ও প্যানেল আইনজীবীদের অপসারণ করতে হবে। অন্যথায় আমরা হাইকোর্ট চত্বর ছাড়ব না।
বেলা ৩টার দিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞার কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। পরে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আসেন। রেজিস্ট্রার জেনারেলের ঘোষণার পর সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা আগামী রোববার বিকেল পর্যন্ত দেখব। এ পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি স্থগিত থাকবে।
যা বললেন আইনজীবীরা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন সমকালকে বলেন, ‘আন্দোলন করার জন্য ছাত্রদের কেউ ডেকে আনেনি, তারা নিজেরাই এসেছে। এখন প্রধান বিচারপতি কাকে বেঞ্চ দেবেন, আর কাকে দেবেন না, সেটা তাঁর সাংবিধানিক এখতিয়ার। এখানে আমাদের কিছুই বলার নেই। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সেটা দেখবে।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ দাবি আমাদের জন্য অশনিসংকেত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি নিয়ে যাদের গায়ে লাগার কথা, তারা তো নিশ্চুপ।’ তিনি বলেন, ‘আদালতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ যতটুকু ছিল, ভবিষ্যতে তার মর্যাদা বিনষ্টের দ্বারপ্রান্তে।’
সুপ্রিম কোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে আন্দোলন করা হচ্ছে, সেটা যেন নিয়মতান্ত্রিক, সাংবিধানিক এবং সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে হয়– সেটাই আমার প্রত্যাশা।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলনের কারণে বিচারকদের বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। এটা চার দিন আগেই প্রধান বিচারপতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, আমার যেটা করার, সেটা ২০ অক্টোবরের আগেই করব।’
দিনভর নানা গুজব
গতকাল বিক্ষোভ চলাকালে প্রথমে খবর আসে প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরে দুপুরে জানা যায়, ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, আপাতত হাইকোর্ট বিভাগে ১২ বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না।
আইনজীবীর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা
দুপুর ১টার দিকে সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ কয়েকজন আন্দোলনকারী সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন আইনজীবী শাহ মো. বাবর। ওই সময় দু’জন বাগ্বিতণ্ডায় জড়ালে ভেতরে ঢুকে যায় অর্ধশত আন্দোলনকারী। পরে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে কয়েকজন আইনজীবীর উপস্থিতিতে বিষয়টি সুরাহা হয়।
উল্লেখ্য, গত ১০ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকে হাইকোর্টে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। এক পর্যায়ে তাদের দাবির প্রেক্ষাপটে ওই দিনই পদত্যাগ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি।