বিদায়ের সুর পিএসসিতে
অনলাইন ডেস্ক: সরকার পতনের পর থেকে কার্যত স্থবির সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কর্মকর্তাদের একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হচ্ছে। অফিসে নিয়মিত আসছেন না কমিশনের সদস্যরা। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও সদস্যরা পদত্যাগের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিষয়টি জানিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও কোনো নির্দেশনা আসেনি।
নিয়োগ পরীক্ষাগুলো স্থগিত করায় হতাশ হচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি যথাসময়ে প্রকাশ করা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। পিএসসির কর্মকর্তারাই এ নিয়ে ‘অন্ধকারে’। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় আস্থার সংকটে থাকা সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের দাবি তুলছেন নিয়োগপ্রত্যাশীরা। পিএসসি পুনর্গঠনের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন তারা। শুধু নিয়োগ পরীক্ষাই নয়, নন-ক্যাডার ও জনপ্রশাসনের অধীনে পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পরীক্ষাও স্থগিত করা হচ্ছে।
পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসেনসহ সব সদস্যের পদত্যাগ দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে। গত রোববার সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত পিএসসির সামনে অবস্থান করেন ৪১তম বিসিএসের নন-ক্যাডার প্যানেলপ্রত্যাশী, ৪৩তম বিসিএসের নন-ক্যাডার (লিস্টপ্রত্যাশী) ও রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদের চাকরিপ্রত্যাশীরা।
একাধিক সূত্র জানায়, বিদায়ের সুর বাজছে পিএসসিতে। সাবেক সরকারের সময় দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া ‘সোহরাব কমিশন’ যে কোনো সময় বিদায় নিতে পারে। সরকার পতনের পর চেয়ারম্যান ও সদস্যরা ধরেই নিয়েছেন, তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে। তারা সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন। অনেকে নিয়মিত অফিসও করছেন না। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভার্চুয়ালি অফিস করছেন। চেয়ারম্যানসহ তিন-চারজন সদস্য অফিস চালিয়ে গেলেও ৪১ থেকে ৪৩তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের প্রার্থীদের আন্দোলনের কারণে তারা এখন নিয়মিত আসছেন না।
পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেনের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছে সমকাল। পিএসসিতে বিদায়ের সুর বাজছে– এটি স্বীকার করে তিনি বলেন, সরকার এই প্রতিষ্ঠানের জন্য যা ভালো মনে করবে, তা হবে।
পিএসসির অধীনে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের প্রায় ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। তবে পিএসসির নিজস্ব তদন্তে প্রশ্ন ফাঁসের কোনো প্রমাণ মেলেনি বলে সম্প্রতি জানানো হয়। এদিকে রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পিএসসির দুই উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেন। কমিশন পুনর্গঠনে সহজ উপায় হচ্ছে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। পদত্যাগ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, শিগগিরই পিএসসি পুনর্গঠন করা হবে। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা কমিশনে স্থান পাবেন।
পিএসসিতে স্থবিরতার কারণে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি যথাসময়ে প্রকাশ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারাই এ নিয়ে ‘অন্ধকারে’। পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) দপ্তর সূত্র জানায়, বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। কয়েক বছর ধরে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে। এবারও এমন পরিকল্পনা নিয়েছিল পিএসসি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার যথাসময়ে (৩০ নভেম্বর) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সম্ভাবনা খুবই কম।
পিএসসির একজন সদস্য ও একজন যুগ্ম সচিব নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, স্থবিরতার প্রভাব পড়ছে সব কাজেই। এভাবে চলতে থাকলে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিও পিছিয়ে যেতে পারে। পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আনন্দ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের জায়গা থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা আছে। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিষয়গুলো অবগত করে থাকি। সেখান থেকে এখনও নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যথাসময়ে চাহিদাপত্র পেলে বিজ্ঞপ্তি ঠিক সময়ে দেওয়া যাবে, দেরি হলে তা পিছিয়ে যেতে পারে।’
তবে স্থবিরতার কথা স্বীকার করতে রাজি নন চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন। তিনি বলেন, পিএসসিতে স্থবিরতার কোনো সুযোগ নেই, এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রতিদিনই কোনো না কোনো কাজ থাকে। বিভিন্ন কাজে প্রতিদিনই চেয়ারম্যান অথবা কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। নিয়োগ পরীক্ষার জট সম্পর্কে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে নানা কারণে পরীক্ষা নিতে পারিনি। এখন পরীক্ষাগুলো নেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছি। ৪৪তম বিসিএসের বাকি ভাইবা, ৪৫তমের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ৪৬তম বিসিএসের কাজ চলছে। নন-ক্যাডার কিছু নিয়োগ পরীক্ষার কাজও প্রক্রিয়াধীন।
সরকারের সঙ্গে ‘সংযোগবিহীন’
পিএসসির পরীক্ষা শাখার একজন সহকারী পরিচালক জানান, ৫ আগস্টের পর পিএসসি থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পত্রগুলোর ৯০ শতাংশের প্রতিউত্তর মেলেনি। পিএসসির পরিস্থিতি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিনিয়ত চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসিতে এসে বিক্ষোভ করছেন, তাদের দাবির বিষয়ে জানানো হলেও কোনো পরামর্শ ও নির্দেশনা মন্ত্রণালয় দেয়নি।
কর্মকর্তারা জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পিএসসি এখন অনেকাংশে সংযোগবিহীন। এমনটি চলতে থাকলে পিএসসি ঘিরে সংকট বাড়বে। অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রশাসনে কর্মরতদের রদবদল চলছে। ঢেলে সাজানোর এ প্রক্রিয়া পুরোটাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে করতে হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমন অবস্থায় পিএসসি নিয়ে করণীয় ঠিক করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
নিয়োগ পরীক্ষাগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছে সরকার
নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, পিএসসির চলমান নিয়োগ পরীক্ষাগুলোর বিষয়ে নতুন কিছু নির্দেশনা দিতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। এ নির্দেশনা এলে পিএসসির কাজে গতি বাড়বে বলে মনে করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ৪৬তম বিসিএসসহ তিন নিয়োগ পরীক্ষার তথ্য চেয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দায়িত্ব নিয়েই পিএসসির কাছে নিয়োগ পরীক্ষার তথ্য চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সব সময় পিএসসির বিষয়ে সরব ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে নতুন কিছু পরামর্শ বা নির্দেশনা আসতে পারে।
পিএসসি সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার ৪৬তম বিসিএস, রেলওয়ের পরীক্ষা ও স্টাফ নার্স নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে কোন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে এসব পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব বিবেচনা করে সরকার কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারে।