শহিদ সেনা দিবস ঘোষণা ও পুনরায় তদন্ত করে দোষীদের বিচার চাই

অনলাইন ডেস্ক: পিলখানা হত্যা দিবসকে শহিদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার দাবি করেছেন শহিদ লে. কর্নেল এনশাদ ইবন আমিনের স্ত্রী ডা. রোয়েনা এনশাদ। তিনি বলেন, আমরা নিজেরাই নিহত ৭৪ জন সেনাকে শহিদ বলি কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যাকাণ্ডের দিনটি শহিদ সেনা দিবস, আর হত্যাকাণ্ডের শিকার সেনাদের শহিদ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে সরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মর্যাদা দিলে আমাদের ও ছেলেমেয়েদের একটা সান্ত্বনার জায়গা থাকবে।

সম্প্রতি ইত্তেফাককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে দিনের ঘটনা তুলে ধরেন রোয়েনা এনশাদ, যিনি পেশায় একজন চিকিৎসক। জানান তার অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি বলেন, লে. কর্নেল এনশাদ ইবন আমিন বিডিআর সদর দপ্তরে রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিট, ঢাকার অধিনায়ক হিসেবে সে সময় তখন দায়িত্ব পালন করছিলেন। ছেলে এম মাশাহেদ বিন এনশাদ সবে বুয়েটে ভর্তি হন, ক্লাসও শুরু হয়নি, আর মেয়ে নুজহাত নাহিয়ান এনশাদের এসএসসি পরীক্ষা চলছিল। সেদিন সকাল ৮টার দিকে তিনি নাস্তা খেয়ে দরবার হলের দিকে চলে যান। ৯টার দিকে মেয়েকে নিয়ে আমি অগ্রণী স্কুলের উদ্দেশ্য বের হই। আমি গোলাগুলির শব্দ পাই। গোলাগুলি বাড়তে থাকে, আমার সঙ্গে বিডিআর-এর গাড়ি এবং চালকের বিডিআর-এর পোশাক দেখে আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারের অনেকই জানতে চায় কী হয়েছে। গোলাগুলির সঙ্গে আমার উত্কণ্ঠাও বাড়ছিল। আমি কর্নেল সাহেবকে ফোন দেই। তিনি আমাকে বলেন, তুমি আর ভেতরে এসো না। ছেলে ভেতরে আছে শুনে বলেন ওর সাথে আমি কথা বলছি। কিন্তু আমি ছেলেকে ফোন দিয়ে জানতে পারি তার বাবার আর তাকে ফোন দেওয়া হয়নি। আমি ছেলেকে বাসায় তালা দিয়ে ওপরে একজন ভাবি ছিলেন তাদের বাসা যেতে বলি।

তারপর ওনাকে শত ফোন দিয়ে আর পাইনি। শেষে একবার ফোন ধরেন, কিন্তু কথা বলতে পারেনি।

এ প্রসঙ্গে রোয়েনা এনশাদ বলেন, তখন আমার মনে হলো কেউ ফোনটা টেনে নিয়ে গেছে তার কাছ থেকে, আমি ভেতরে অনেক শব্দ শুনতে পাই। বিকালের দিকে আমার ছেলেসহ ওই পরিবারকে ওরা ধরে নিয়ে যায়। দুই দিন পরে যখন সেনাবাহিনী আটককৃতদের উদ্ধার করে তখন আমি আমার ছেলেকে পাই। আমার ছেলে ও ভাশুর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লে. কর্নেল এনশাদের মরদেহ শনাক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, দুটি টিএনএজ সন্তান দিয়ে আমার যুদ্ধটা তখন থেকে শুরু হলো। আমার ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করিয়ে উনি চলে যান। মেয়ে এসএসসি পাশ করে হলিক্রসে ভর্তি হয়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তাকে একটা ভালো জায়গায় ভর্তির জন্য আমি সেভাবে সহযোগিতা করতে পারিনি, যেভাবে ছেলেকে করেছি। তারপরও আলহামদুলিল্লাহ সে ভালো ফল করে এসআইএ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ওরা ট্রমাটাইজ ছিল, বিশেষ করে আমার ছেলে। ওদের কাউন্সেলিং করে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে এনেছি।

ছেলেমেয়ের বিয়েতে বাবার অনেক বড় ভূমিকা থাকে। দুই সন্তানের বিয়েতে আমি একাই ছিলাম। ওরা সবসময় বাবার প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে আমার বাবার পরিবার আর আমার শ্বশুরের পরিবার বিশেষ করে আমার শাশুড়ি চট্টগ্রামের সাহিত্যিক ফাহমিদা আমিন যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন।

সেনাবাহিনীতে একটি নিয়ম আছে—কোনো অফিসার মিশনে, যুদ্ধে বা যে কোনো রকম দায়িত্ব পালনের সময় নিহত হলে তার পরিবার সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পায়। ৭৪ জন সেনা সদস্য শহিদ হয়েছেন, তারা একই সহযোগিতা পেয়েছে। এমন একটি ঘটনায় এত মেধাবী সেনা কর্মকর্তা শহিদ হলেন তাদের কাউকে নিয়মের বাইরে কোনো বিশেষ সহযোগিতা করা হয়নি।

আমি মনে করি, এই ঘটনা কেন ঘটল—সে কারণটা পরিষ্কার করা হয়নি। জাতি এবং শহিদ সেনার পরিবারের অধিকার আছে এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ জানার। আমার স্বামীকে কোনো অপরাধ ছাড়াই হত্যা করা হলো, সেজন্য আমার মানসিক একটা অস্থিরতা আছে। কিন্তু আমি যদি জানতে পারতাম কেন তাকে হত্যা করা হয়েছে তবে, কিছুটা স্থিতিশীলতা আসত। এখানে অনেক প্রশ্নও থেকে যায়, কেন আমরা আজও এই সকল প্রশ্নের উত্তর জানতে পারিনি। কেন এতগুলো সেনা কর্মকর্তাকে বন্দি করার পরও সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার করতে এলো না। কেন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ বিডিআরের গেটে ট্যাংক পাঠিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল, ভেতরে ঢুকল না। বিডিআর সৈন্যরা সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মতো এত দক্ষও না। একটি ট্যাংকও যদি সেদিন বিডিআরের ভেতরে ঢুকত তাহলে তারা ভয়ে পালিয়ে যেত। এত হত্যাকাণ্ড ও লুটপাট হতো না। কেন বিচারের তদন্তটা সবাইকে জানাতে নিষেধ করা হয়, স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের মনে খটকা লাগে?

আমি মনে করি, এই বিচারটা পুনরায় তদন্ত করে শুরু করা উচিত। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সবার সামনে আসা উচিত। তিনি বলেন, আমি মনে করি এটা কোনো বিদ্রোহ না। বিদ্রোহ হলে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরও তারা কেন হত্যাকাণ্ড ঘটাল? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে তারা কেন আবার হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হলো। শুরু থেকে দিবসটা নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও বিচারের বিষয়টি পাশ কাটানো হতো। গণমাধ্যমে বিচার নিয়ে আমাদের কথা সঠিকভাবে প্রকাশ করা হতো না।

Related Articles

Back to top button