গাজা দখলের পরিকল্পনা, ইসরায়েলকে চাপে ফেলা সম্ভব!

অনলাইন ডেস্ক: মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে গত শনিবার এভাবে লেখা হয়েছে: দক্ষিণ গাজার এক নারী চিকিৎসক আলা-আল-নজর নাসের মেডিক্যাল কমপ্লেক্স হাসপাতালে গিয়েছিলেন হাসপাতালে আসা অসুস্থ বা আহত মানুষদের সেবা করতে।
তিনি যখন অন্যের সেবা দিচ্ছিলেন। তখনই তার সাত সন্তান এবং স্বামীকে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে সাত সন্তানই ছিল মৃত। আরেক সন্তান ও স্বামীর (তিনিও চিকিৎসক) অবস্থা আশঙ্কাজনক। সাত সন্তানের সবার শরীর পুড়ে গেছে। কারো খণ্ড-বিখণ্ড দেহ। আর দুই সন্তান ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে মারা। যায়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ৯ সন্তানই মারা গেছেন। গাজার অবস্থাকে অনেকে বর্ণনা করছেন এভাবে দুঃস্বপ্নের দুনিয়া। যেখানে ধ্বংস আর মৃত্যুই একমাত্র সত্য। সভ্যতা ও মানবিকতা থেকে বহুদূর।
আন্তর্জাতিক চাপটা কেমন
১৯ মাস ধরে গাজায় হামলা চালানোর পর ইসরায়েল। তার নিকটতম পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। কিছু মহল থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেই যুদ্ধের অর্থ, অস্ত্র সরবরাহ, পুনরায় সরবরাহ সবটাই করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্য মিত্ররাও অন্য মিত্ররাও নিজেদের মতো করে কোনো না কোনোভাবে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ইসরায়েল সেই সমর্থন হারিয়ে ফেলেছে। অন্তত ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার কথা মাথায় রাখলে বিষয়টা তাই দাঁড়ায়।
ইসরায়েলি দৈনিক ‘হারেজ’ গত সপ্তাহে তাদের এক শিরোনামে লিখেছে-কূটনৈতিক সুনামি আসছে’। পত্রিকাটি সতর্ক করে জানিয়েছে, গাজায় সম্পূর্ণ উন্মত্ততার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ইউরোপ। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজায় ইসরায়েলের চরম আচরণের নিন্দা জানায়।
তারা হুঁশিয়ারি দেয়, সামরিক আগ্রাসন থামানো না হলে এবং মানবিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণের প্রতিক্রিয়ায় ‘টার্গেটেড স্যাংশনের’ও হুমকি দিয়েছে। ২৪টি অনুদানদাতা দেশ ইসরায়েলসমর্থিত গাজা সহায়তা বিতরণ কাঠামোর নিন্দা জানায়।
যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান। বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে। ২০২৩ সালের যৌথ সহযোগিতা রোড ম্যাপ পুনর্বিবেচনার ঘোষণা দিয়েছে। ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এছাড়া লণ্ডনে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত টিপি হোতোভেলিকে ফরেন অফিসে তলব করা হয়।
এতদিন এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত রাশিয়া বা ইরানের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রেই নেওয়া হতো। ইসরায়েলের সঙ্গে ২৫ বছর পুরোনো অ্যাসোসিয়েশন চুক্তি পুনর্বিবেচনার হুমকি দিয়েছে ইইউ।
সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থক পাশে
ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতানিয়ার এবং তার সরকারের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের কেউ কেউ গাজার ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন। তবুও যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেবে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
তবে ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট বলেন, এটি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে যাবে। যদিও সম্পর্কের মধ্যে কোনো ভাঙন দেখা যাচ্ছে না। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি বিষয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করেনি।
ইসরায়েলকে আগে না জানিয়েই তারা ইয়েমেনের ইরানসমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছে, গাজা থেকে মার্কিন নাগরিক এডান আলেকজান্ডারের মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে একতরফাভাবে আলোচনা করে। সৌদি আরবের কাছে মার্কিন বিনিয়োগ এবং সম্ভাব্য মার্কিন অস্ত্র চুক্তির শর্ত হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
হুথিদের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনার জবাবে ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি ইসরায়েলি গণমাধ্যমকে বলেছেন যে, তার জাহাজগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে আমেরিকার ইসরায়েলের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। নেতানিয়াহু নিজেকে মার্কিন রাজনীতিতে খেলার একজন কর্তা হিসেবে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পরিচালনা ও বজায় রাখার জন্য এবং যে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনকে পাশে রাখার জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন এমন একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
লোভাট বলেন, মনে হয় ট্রাম্প প্রশাসন এবং ইসরায়েলি সরকারের মধ্যে কিছু দিনের কার্যত্রম স্পষ্টতই নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। মার্কিন কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুর প্রতি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন। তবে জোর দিয়ে বলেছেন যে, এই হতাশাগুলো ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের ক্ষেত্রে অবস্থান পরিবর্তনের সমান নয়, যে দেশটিতে নয়, যে দেশটিকে প্রেসিডেন্ট এখনো আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী মিত্র হিসেবে দেখেন।
চাপ মোকাবিলা সম্ভব!
ইসরায়েলি চ্যানেল ১২ কর্তৃক প্রকাশিত একটি মতামত জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ জিম্মি মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধ শেষ করার পক্ষে, যেখানে মাত্র ২৫ শতাংশ সম্প্রসারিত সামরিক অভিযানকে সমর্থন করেছেন।
ইসরায়েলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইন বিশেষজ্ঞ অ্যারি রাইখের মতে, নেতানিয়াহুর সরকারের ওপর বহিরাগত চাপ কাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলতে পারে না। তিনি বলেন, যখন যা বিদেশি দেশগুলো অন্য অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, বিশেষ করে যে বিষয়গুলো তাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়, যেমন তাদের জাতীয় নিরাপত্তা, তখন এটি সাধারণত বুমেরাং হিসেবে কাজ করে এবং এটি আসলে জনগণকে সরকারকে আরো বেশি সমর্থন করতে বাধ্য করে।
ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত তার পশ্চিমা মিত্রদের হুমকি উপেক্ষা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাদের বিরুদ্ধে ৭ অক্টোবরের হামলাকারীদের একটি বিশাল পুরস্কার প্রদান করার অভিযোগ করেছেন।
অন্যদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে, বহিরাগত চাপ ইসরায়েলকে তার অস্তিত্ব এবং ধ্বংসের জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে সুরক্ষার লড়াই থেকে বিচ্যুত করবে না। বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাঙ্কশনস (বিডিএস) আন্দোলনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ওমর ধারঘৌতি সিএনএনকে বলেছেন যে, ইসরায়েলের মিত্ররা ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করলে তাদের পদক্ষেপের খুব একটা ফলাফল আসবে না। সম্পূর্ণ অস্ত্র নিষেধারা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্থগিত না করলে ইসরায়েল তার পথ পরিবর্তন করার সম্ভাবনা কম।
তিনি যুক্তি দেন যে, কানাডা, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে সহযোগী ছিল। সামরিক, গোয়েন্দা, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। তিনটি দেশেরই ইসরায়েলের সাথে দীর্ঘদিনের চুক্তি রয়েছে। যার মধ্যে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।