বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি

এলসি খুলছে না সোনালী ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এমনকি ব্যাংকগুলো জ্বালানি তেল আমদানির ঋণপত্রও (এলসি) খুলছে না। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে এলসির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটি গত জুন মাস থেকে জ্বালানি তেল আমদানির বিপরীতে কোনো এলসি না খোলায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের জ্বালানি তেল সরবরাহ দুরূহ হয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

জ্বালানি তেল আমদানির বিপরীতে বিল পরিশোধে দেরি হওয়ায় চুক্তি অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে জরিমানাও গুনতে হচ্ছে বিপিসিকে। এসব জানিয়ে চলতি মাসের শুরুতে জ্বালানি বিভাগে জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ-সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য নিয়ে একটি সারাংশ পাঠায় সংস্থাটি। যদিও বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে দেরি করলেও পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।

বিপিসির পরিচালক (অর্থ) ও যুগ্ম সচিব মো. আবদুল মতিন এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে কিছু সমস্যা তো হয়েছে। এখন রেমিট্যান্স আসা শুরু হয়েছে। আমরা ডলার পাচ্ছি। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ৭৭ মিলিয়ন ডলার এবং গত (মঙ্গলবার) ৪৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। আমরা আশা করছি পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত বিপিসির নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে তেল আমদানির বিপরীতে মোট বকেয়ার পরিমাণ ৪০৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে বেশি বকেয়া রয়েছে আন্তর্জাতিক তেল সরবরাহকারী কোম্পানি ভিটলের কাছে। কোম্পানিটির পাওনা ১৪৮ দশমিক শূন্য ৬ মিলিয়ন ডলার। এর পরই রয়েছে ইনক কোম্পানি। তাদের পাওনা ৫৭ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলার। সিঙ্গাপুরের কোম্পানি ইউনিপেক পাবে ৫৬ দশমিক ৩৩ ডলার। ঋণদাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) পাওনা ৫১ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া বিএসপির ৪৬ দশমিক ৯০ ডলার, আইওসিএলের ২৫ দশমিক ২৮ মিলিয়ন এবং পিটিএলসিএলের ২১ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে।

এ পরিমাণ বকেয়া পরিশোধের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এলসি খোলা হলেও ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে এলসি নিষ্পত্তি করতে পারেনি। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকে বকেয়ার পরিমাণ ৬৯ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার, অগ্রণী ব্যাংকে ১৩২ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার, সোনালী ব্যাংকে (ঢাকা) ৯৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার, সোনালী ব্যাংক (চট্টগ্রাম) ৫০ দশমিক ১৪ মিলিয়ন ডলার এবং রূপালী ব্যাংকে ৬১ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।

এর আগে ২ সেপ্টেম্বর ‘সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের আমদানি এলসি খোলা এবং মূল্য পরিশোধ বিলম্ব সংক্রান্ত’ চিঠি জ্বালানি বিভাগের পাঠায় বিপিসি। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিপিসি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানি করে সরকার-নির্ধারিত মূল্যে পুরো দেশে সরবরাহ করছে। বিপিসিকে প্রতি মাসে গড়ে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের জন্য ১৬-১৭টি এলসি খুলতে হয়। প্রতিটি এলসির মূল্য গড়ে প্রায় ২৬ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার। এলসিগুলো সোনালী ব্যাংক পিএলসি, জনতা ব্যাংক পিএলসি, অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি ও রূপালী ব্যাংক পিএলসির মাধ্যমে খোলা হলেও গত জুন মাস থেকে সোনালী ব্যাংক সম্প্রতি এলসি খুলতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিগত সময়ে সোনালী ব্যাংক পিএলসি কর্তৃক মাসে ৪-৫টি করে এলসি খুললেও চলতি বছরের জুন থেকে বিপিসির এলসি খোলা থেকে বিরত রয়েছে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে এর আগে খোলা এলসিগুলোর আমদানি মূল্য ব্যাংকটি যথাসময়ে পরিশোধ করছে না। বিপিসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রতিদিন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সোনালী ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন সরবরাহকারীর বকেয়া পাওনার অর্থ পরিশোধে বিলম্বিত সময় ৪৫ দিন থেকে সর্বোচ্চ ১৩০ দিন পর্যন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ না করার কারণে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কিছু কার্গো ডেফার্ড ও বাতিল করছে। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট লেক্যানে চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে কার্গো এলেও ‘ফাইন্যান্সিয়াল হোল্ড’ আরোপ করে পণ্য খালাসে বিলম্ব করছে। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ সমুন্নত রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বিপিসি এবং সোনালী ব্যাংক উভয়ই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। দেশের জন্য এ অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি পণ্যের এলসি সোনালী ব্যাংক কর্তৃক না খোলা এবং মূল্য পরিশোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করার বিষয়টি বোধগম্য নয়। ভবিষ্যতে জ্বালানি তেল নিয়ে কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে তার দায়দায়িত্ব সোনালী ব্যাংককে বহন করতে হবে।

সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ভিটলের জ্বালানি তেলের এলসি মূল্য পরিশোধে সবচেয়ে বেশি দেরি হয়েছে। গত ১ এপ্রিল ভিটলের ২৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধে এলসি খোলা হয়। এর বিপরীতে প্রায় এক মাস পর ২৬ ও ২৮ এপ্রিল দুই দফায় ১৫ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে। অবশিষ্ট বকেয়া ৯ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার ১৩০ দিন পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি। এমন আরও ২১টি এলসির বিপরীতে মূল্য পরিশোধ করেনি সোনালী ব্যাংক।

বিপিসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, চুক্তি অনুসারে বিলম্বের জন্য বছরে এখন সাড়ে ৬ শতাংশ হারে অর্থ মাশুল হিসেবে দিতে হবে। যদিও দীর্ঘ ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে বিলম্ব মাশুলের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো চাপ দেয়নি। তবে দ্রুত বিল পরিশোধে তাগাদা দিচ্ছে নিয়মিত।

জানা গেছে, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। নিয়মিত খুচরা মূল্য সমন্বয় করায় বর্তমানে প্রতি মাসে তেল বিক্রি থেকে যে পরিমাণ আয় হয়, তা দিয়েই আমদানি বিল পরিশোধ করা সম্ভব। বরং বিক্রীত অর্থ থেকে কিছু লাভও হয় বিপিসি এবং বিপণনকারী কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের। কিন্তু আমদানি হয় মার্কিন ডলারে। আর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি থাকায় সময়মতো নির্ধারিত পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে ধারাবাহিক যোগাযোগ করেও প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান হচ্ছে না।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে ২ লাখ ৬৫ হাজার টন ডিজেল, ৬৫ হাজার টন জেট ফুয়েল, ২৫ হাজার টন অকটেন এবং ৭৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বর্তমান মূল্য পরিশোধ পরিস্থিতির কারণে সেপ্টেম্বর মাসের আমদানি সূচির বিষয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।

বিপিসি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার টন তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এর বাইরে ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস (অকটেন), জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে।

Related Articles

Back to top button