দুই প্রান্তিকে ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ চা রফতানি
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেড় দশক আগেও বাংলাদেশের চা খাত ছিল রফতানিনির্ভর। ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কমতে থাকায় আমদানিনির্ভর হয়েছে অর্থকরী এ খাত। তবে আশার কথা হচ্ছে, রফতানি স্থবিরতা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বিগত ছয় বছরের (উৎপাদন মৌসুম) মধ্যে সর্বোচ্চ চা রফতানি করেছে দেশীয় কোম্পানি ও বাগান মালিকরা।
জানা যায়, ২০০৭-০৮ মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে চা রফতানি হয়েছিল ১ কোটি ৭ লাখ ৯৮ হাজার কেজি। এরপর থেকে রফতানি কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকে। ২০১৫-১৬ মৌসুমে রফতানি নেমে আসে মাত্র ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজিতে। তবে ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে চা খাত। ২০২৩-২৪ উৎপাদন মৌসুমে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে চা রফতানি হয়েছে ১৮ লাখ ৪ হাজার কেজি। মৌসুমের বাকি মাসগুলোয় এ ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এক দশকের সর্বোচ্চ চা রফতানির রেকর্ড করবে অর্থকরী এ খাত।
সাধারণত চা উৎপাদন ও নিলামের মৌসুম ধরা হয় প্রতি বছরের এপ্রিল থেকে। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে চা বাগানের বার্ষিক পরিচর্যা ও গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহের কারণে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তবে মার্চের মাঝামাঝি থেকে নতুন করে চা উৎপাদন শুরু করে বাগানগুলো। মার্চের শেষার্ধে কিংবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে নিলাম ও চা বিপণন শুরু হয়। এ হিসাবে গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রফতানি হওয়া চা বিগত ছয় মৌসুমের যেকোনো সময়ের চেয়েও বেশি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ মৌসুমে চা রফতানিতে সর্বনিম্ন রেকর্ড গড়লেও পরের মৌসুমেই তা বাড়তে শুরু করে। ওই সময়ে দেশে চায়ের উৎপাদন বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে রফতানি বাড়তে শুরু করে। তবে দেশে বার্ষিক চা ভোগের পরিমাণের চেয়ে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কম থাকায় রফতানিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি দেশের বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। তবে গত কয়েক বছর দেশে চা উৎপাদন ১০ লাখ কেজিরও বেশি হওয়ায় রফতানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য (অর্থ ও বাণিজ্য) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের চায়ের মান অন্য দেশের চেয়েও ভালো। দেশে চা ভোগের পরিমাণ বাড়তে থাকায় রফতানি কিছুটা কমে এলেও বর্তমানে হারানো গৌরব ফিরে আসছে। আমদানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। অন্যদিকে দেশীয় উৎপাদনে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে রফতানির পরিমাণ বাড়ছে।’ এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী খাত হিসেবে চা নতুন করে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশে বছরে চা ভোগের চাহিদা নয় থেকে সাড়ে ৯ কোটি কেজির কিছু বেশি। ২০২২ সালেও দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি। ২০২৩ সালে এসে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজিতে। চলতি বছর দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৬০ লাখ কেজি বাড়িয়ে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি নির্ধারণ করা হয়। বছরের প্রথম ছয় মাসের উৎপাদন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে বাড়তি চা উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখছে চা বোর্ড। ফলে মৌসুমের বাকি মাসগুলোয় রফতানি ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ চা রফতানি সম্ভব বলে মনে করছেন বাগান মালিক ও চা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা।
চা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০১-০২ মৌসুমে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম চা উৎপাদনকারী ও রফতানিকারক দেশ। ওই সময়ে দেশ থেকে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৩৮ লাখ ২ হাজার কেজি চা রফতানি হয়েছিল। দুই দশক আগের ওই রফতানি থেকে বাংলাদেশ ১ কোটি ৬৪ লাখ ৬৮ হাজার ডলার আয় করেছিল।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম শীর্ষ খাত ছিল চা। কিন্তু অদক্ষতা, দুর্নীতিসহ চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারায় ২০০৯-১০ সালের পর অন্যতম চা আমদানিকারকে পরিণত হয় বাংলাদেশ। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের ফলে আমদানি অনেকটা কমে এলেও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে চা প্রবেশ করছে। ফলে দেশের নিলাম বাজারগুলোয় উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে চা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন উৎপাদকরা। চোরাই পথে চা প্রবেশ বন্ধ করার পাশাপাশি গুণগত মানসম্পন্ন চা উৎপাদন বাড়ানো গেলে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানির পরিমাণ আরো বাড়বে। পাশাপাশি আমদানি শতভাগ কমানো গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে আশা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের চা বাগান মালিকরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও উৎপাদন বাড়াতে সক্রিয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ অনুযায়ী চা বিক্রি করতে না পারায় অনেক বাগানই রুগ্ণ হয়ে পড়ছে।’
কয়েক মাস আগে চা বিপণনের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘উৎপাদনের সঙ্গে বিক্রির ন্যূনতম সামঞ্জস্য থাকলে দেশের চা খাত আরো বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি রফতানি আয়েও বড় ভূমিকা রাখবে।’