মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ছাড়াই ‘বারে’ চলে অভিযান

অনলাইন ডেস্ক: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে অনুমোদিত বারে বিভিন্ন সংস্থার পরিচয়ে অভিযান পরিচালনার খবর পাওয়া গেছে। র‌্যাব-পুলিশ ছাড়াও আলাদা পরিচয়ে হুটহাট অভিযানে নেমে কাগজপত্র না থাকার অজুহাতে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া দেশের অনুমোদিত বারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থার এককভাবে অভিযান পরিচালনার নিয়ম নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে বা তাদের প্রতিনিধি উপস্থিতি সাপেক্ষে যেকোনও সংস্থা অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা বারে অভিযানের নামে হয়রানীর অভিযোগ তুলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি বারের মালিক জানান, গত ২৩ এপ্রিল র‌্যাব-১ এর সদস্য পরিচয় দিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাজধানীর উত্তরা আবদুল্লাহপুরে টাইগার এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি বারে অভিযান চালায়। অভিযানের শুরুতেই আগন্তুক ব্যক্তিরা সিসি ক্যামেরা বিকল করে এবং ফুটেজ খুলে নেয়। বার কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই ব্যক্তিরা ১২ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা, চারটি ল্যাপটপ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাতটি মোবাইল ফোন, অফিসিয়াল ফাইল (লাইসেন্স, আমদানি, উত্তোলন সংক্রান্ত ও সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র), ক্রাউন বেভারেজ থেকে উত্তোলনকৃত বৈধ বিয়ারের শতাধিক কেস, কেরু এ্যান্ড কোং-এর বৈধ প্রায় ৫০ কেস এবং ব্রান্ড রেজিষ্ট্রেশন থাকা অ্যালকোহল জব্দ করে। এ সময় তারা বারের কর্মকর্তাদের মারপিট করে এবং চার জনকে আটক করে নিয়ে যায়।

এর আগে গত মার্চ মাসে মহাখালীতে ব্যারন নামে একটি বারে অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা ও অ্যালকোহল জব্দ করে নিয়ে যায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একই মাসে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের একটি বারে অভিযান চালানো হয় র‌্যাবের নাম ব্যবহার করে। ওই বার তিনটির কর্তৃপক্ষ জানায়, নগদ টাকা ও জব্দ করে নিয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকার অ্যালকোহলের তালিকা তাদের দেওয়া হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ২০ থেকে ২৩ ধারা পর্যন্ত বারে অভিযানের বিষয়ে বলা রয়েছে। আইনের ২০ ধারায় বারে প্রবেশ ও ইত্যাদি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালককে। এই ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত বারে মহাপরিচালক বা তার নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রবেশ, জব্দ ও তল্লাশি করতে পারবে। তবে অন্য কোনও বাহিনীর কথা বলা নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বারের অনুমোদন বা লাইসেন্স মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দেয়, তারাই এর দেখভাল করেন। বারে কোনও সংস্থা বা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই মহাপরিচালকের অনুমোদন নিতে হবে এবং তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখতে হবে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, উত্তরার টাইগারসহ অন্যান্য বারে অভিযানের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাউকে জানানো হয়নি। মহাপরিচালকের কোনও প্রতিনিধিও ছিলেন না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ঢাকা উত্তরা জোন) শামীম আহমেদ জানান, টাইগার বারে অভিযানের বিষয়ে অধিদপ্তর অবগত নয়। এছাড়া অন্যান্য বারে অভিযানের বিষয়েও তাদের জানানো হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে রেস্টুরেন্ট ও বার মালিকরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিভিন্ন সংকটের কথা জানান। এরপর অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে। সেই সার্কুলারে তিনি উল্লেখ করে দেন, দেশের বারগুলোতে কারা কীভাবে অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। এই সার্কুলার দেশের সকল পুলিশ সুপার, ডিআইজি অফিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ২৭ টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। সেখানেই অভিযানের বিষয় স্পষ্ট বলা হয়েছে। সেই সার্কুলার অমান্য করে ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে উত্তরার টাইগার বারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।

ঢাকার দুটি বারের মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, ‘একটি বারের অনুমোদন চাইলেই পাওয়া যায় না। এজন্য বছরের পর বছর বিভিন্ন দফতরে ঘুরতে হয়। কাগজপত্র যাচাইবাছাই ও সঠিক নিয়মকানুন অনুসরণের পর লাইসেন্স মিলে। কিন্তু বার দেওয়ার পর স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন অন্যায়ভাবে চাঁদা দাবি করেন। নানাভাবে হয়রানি করে।’

উত্তরার টাইগার বারে অভিযান পরিচালনার পর র‌্যাব-১ এর কর্মকর্তা মেজর আহনাফ সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স ছাড়াই বারের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বিদেশি মদ আমদানিতে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো কাগজ ছিলো না।

অপরদিকে টাইগার রেস্টুরেন্ট এন্ড বারের ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম দাবি করেছেন, তাদের বৈধ বার লাইসেন্স রয়েছে। যার লাইসেন্স নম্বর ০১/২০২১/২০২২। অভিযান পরিচালনার সময় র‌্যাব সদস্যরা বারের লাইসেন্স দেখতে চায়নি। তারা কোনো কথা শুনতে চাননি। এমনকি বারে বৈধ ও অবৈধ এই দুই ধরনের মদ ও বিয়ারও শনাক্ত করেনি। তারা ঢালাওভাবে সব মদ ও বিয়ার জব্দ করে। এছাড়া অভিযান চালানোর সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তাও সঙ্গে আনেননি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশে ১৮৯টি রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে। এর সকল লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও মজুত দেখভাল করে এই সংস্থাটি।

বাংলাদেশ বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) জাহাঙ্গীর বলেন, র‌্যাব কিংবা ভিন্ন যেকোনো সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছাড়া কোনো বৈধ কিংবা লাইসেন্সকৃত বারে এ ধরনের অভিযানে যেতে পারে না। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্টেও একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের অভিযান না করতে আমাদের সংগঠন থেকেও র‌্যাব মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এ ধরনের অভিযান থেকে প্রতিকার পেতে আমরা আদালতের আশ্রয় নেবো।

Related Articles

Back to top button