রেকর্ড রিজার্ভকে তলানিতে নিয়ে গেছেন আব্দুর রউফ তালুকদার


নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। এ রেকর্ড হয় সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের আমলে। তবে সে রিজার্ভ ধরতে রাখতে পারেননি ফজলে কবির নিজেই। তার আমলে কমতে শুরু করা সে রিজার্ভে ধস নামে বর্তমান গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর। তার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র পৌনে দুই বছরের মাথায় ২৫ বিলিয়ন ডলার ঘরে নেমে আসে গ্রস রিজার্ভ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের ১২ জুলাই দায়িত্ব নেন আব্দুর রউফ তালুকদার। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্থিতি ছিল ৩৯ দশমিক ৭৯১ বিলিয়ন ডলার। আর গত ২৪ এপ্রিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৩৮২ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পৌনে দুই বছরের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমেছে ১৪ দশমিক ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান গভর্নরের পৌনে দুই বছরে যে পরিমাণ রিজার্ভ কমেছে, অন্য কোনো গভর্নরের পুরো মেয়াদেও এত পরিমাণ রিজার্ভ কমেনি।

এদিকে রিজার্ভের পতন ছাড়াও তার পৌনে দুই বছরে ডলারের দরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ডলারের গড় দর ছিল ৯৩ দশমিক ৪৫ টাকা। গত ২৪ এপ্রিল তা দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকায়। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ডলারের দাম বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ‘কৃত্রিমভাবে’ ধরে রাখা এবং দাম ধরে রেখে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ কমে গেছে।

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, প্রতি মাসে রিজার্ভের যে ক্ষয় হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসছে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ও হুন্ডিতে। কারণ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য ছিল ব্যাপক।

বর্তমান গভর্নরের আমলে রিজার্ভ থেকে রেকর্ড পরিমাণ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। মূলত চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় ডলার বিক্রি করে। এখনও ডলার বিক্রি অব্যাহত রয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত পৌনে দুই বছরে রিজার্ভ থেকে ২৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বিক্রি করা হয় ১১ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।

আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দিয়ে ডলার সংকট কাটাতে নানা উদ্যোগ নেন। তবে এসব উদ্যোগে সংকট কাটেনি। বরং সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

সংকট কাটাতে ডলার বিক্রি করার মতো উদ্যোগ নেন। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য প্রথমে শুল্ক বাড়ানো ও শতভাগ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়। এর পর প্রতিটি বড় এলসি যাচাই শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেও কাজ না হওয়ায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ডলারের একটি দর ঠিক করে দিচ্ছে এবিবি ও বাফেদা।

তবে বেশিরভাগ ব্যাংক এ দরে ডলার না পেয়ে বেশি দরে বেচাকেনা করছে। এখনও ঘোষণার চেয়ে বেশি দরে ডলার বেচাকেনা অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ডলারের ভবিষ্যৎ দাম (ফরওয়ার্ড রেট) নির্ধারণ, রপ্তানিকারকের রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসেবে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার সীমা অর্ধেক করে দেয়া, কারেন্সি সোয়াপ এবং আরএফসিডি হিসাব খোলার মতো নানা উদ্যোগ নেয়া হয়।

অন্যদিকে রিজার্ভ পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ সহায়তাও নেয়া হয়। তবে এতে সাময়িক রিজার্ভ বাড়লেও স্থায়ী সমাধান মিলছে না।

গভর্র্নর হিসেবে যোগ দেয়ার এক মাস পর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) প্রাঙ্গণে নবম ব্যাংকিং কনফারেন্সে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বাজারের যে অস্থিরতা, তা দুই-তিন মাসের মধ্যে সহনীয় হয়ে আসবে বলে জানিয়েছিলে আবদুর রউফ তালুকদার। তবে যোগদানের পৌনে দুই বছর পার হওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বাজার এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

আব্দুর রউফ তালুকদারের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন ফজলে কবির। তিনি দুই মেয়াদে সোয়া সাত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তিনি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১৬ সালের ২২ মার্চ। ওই সময় রিজার্ভের স্থিতি ছিল ৩০ দশমিক ৪৯২ বিলিয়ন ডলার। দুই মেয়াদের দায়িত্ব শেষ হয় ২০২২ সালের ৩ জুলাই। অবসরে যাওয়ার সময় রিজার্ভের স্থিতি ছিল ৪১ দশমিক ৯৮৩ বিলিয়ন ডলার। তার আমলে রিজার্ভ বেড়েছিল ১১ দশমিক ৪৯১ বিলিয়ন ডলার।

ফজলে কবিরের আগে ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের দশম গভর্নর হিসেবে যোগ দেন ড. আতিউর রহমান। প্রথম মেয়াদে ৪ বছর পূর্ণ হলে সরকার তার মেয়াদ আরও বাড়ায়। দ্বিতীয়বার আরও চার বছরের জন্য দায়িত্ব পেলেও মেয়াদ শেষ করতে পারেনি তিনি। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাকে আগেই পদত্যাগ করতে হয়। তিনি দায়িত্ব নেয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের স্থিতি ছিল প্রায় ৭ দশমিক ৪৭০ বিলিয়ন ডলার। পদত্যাগ করার সময় রিজার্ভের স্থিতি ছিল ২৭ দশমিক ৮৪২ বিলিয়ন ডলার। তার আমলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছিল ২০ দশমিক ৩৭২ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৫ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। ওই সময় রিজার্ভের স্থিতি ছিল ৩ দশমিক ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার। তিনি বিদায় নেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল। বিদায় নেয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ স্থিতি ছিল ৭ দশমিক ৪৭০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই গভর্নরের আমলে রিজার্ভ বেড়েছিল ৩ দশমিক ৯৮৭ বিলিয়ন ডলার।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অষ্টম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত গভর্নরের হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে রিজার্ভ বেড়েছিল ১ দশমিক ৯০১ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের আমলে রিজার্ভ কমেছে মাত্র ৫৯ মিলিয়ন ডলার এবং লুৎফুর রহমান সরকারের সময় ১৯৫ মিলিয়ন ডলার।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দুই পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে। একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতি। অন্যটি হলো আইএমএফের পদ্ধতিতে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবে রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ৩৮২ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ রয়েছে ১৯ দশমিক ৯৭৩ বিলিয়ন ডলার।

Related Articles

Back to top button