আয় আছে, ব্যাংকের দায় শোধে নেই থার্মেক্স, ইচ্ছাকৃত খেলাপি
প্রাচ্যবাণী ডেস্ক: সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন (২০২৩) অনুযায়ী, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করবে না, তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ ও ব্যাংকের কাছে ঘোষিত উদ্দেশ্যে ঋণের টাকা ব্যয় না করলে ওইসব গ্রাহককে বিবেচনা করা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে। ঠিক এই কাজটিই করেছে ব্যবসায়ী আবদুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। রপ্তানি থেকে বিপুল অর্থ আয় করলেও তারা রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও রূপালী ব্যাংকে থাকা দায় পরিশোধ করছে না। উল্টো পুনঃতপশিলের নির্দিষ্ট ডাউন পেমেন্ট না করেই ঋণ নবায়ন করতে বিশেষ সুবিধা চায় গ্রুপটি। তাদের দ্বিতীয় দফার আবেদন সোনালী ব্যাংক নাকচ করে দিলেও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে থার্মেক্স। অন্যদিকে, রূপালী ব্যাংক গ্রুপটিকে বিশেষ সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপির ব্যাংক পরিচালক হওয়ার সুযোগ নেই। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হয়ে পড়লেও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের (এসবিএসি) পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন থার্মেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদির মোল্লা।
তথ্য বলছে, থার্মেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি করা পণ্যের কাঁচামাল আমদানির এলসি রূপালী ব্যাংকে খুললেও রপ্তানির অর্থ আনছে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে। এমনকি সেই এলসির দায়ও পরিশোধ করছে না। বাধ্য হয়ে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে এলসি দায় পরিশোধ করছে রূপালী ব্যাংক। এতে দিন দিন দায় বাড়ছে থার্মেক্সের। আবার সেই দায়ের অর্থ পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি। গত জানুয়ারি মাসে ওই ঋণের সীমা নবায়ন ও পুনঃতপশিলের জন্য আবেদন করে থার্মেক্স। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের দায় প্রায় ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এই ঋণ পুনঃতপশিলে বিশেষ সুবিধা চাইলেও তা নাকচ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন পুনঃতপশিল করতে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার চালাচ্ছেন আবদুল কাদির মোল্লা। যদিও এখনো কোনো সুরাহা করতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপের ১৫৮ কোটি ৯২ লাখ টাকার এসএমএ (মেয়াদোত্তীর্ণ) মানের ঋণ রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭ কোটি টাকার সাব-স্ট্যান্ডার্ড (এসএস), ৩ কোটি টাকার ক্ষতিজনক মান (বিএল) এবং ১ হাজার ১২১ কোটি টাকার ওভারডিউ দায় রয়েছে। বর্তমানে থার্মেক্স গ্রুপের ব্যাংক খাতে মোট ঋণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রূপালী ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান সিস্টার ডেনিম কম্পোজিটের ১০০ কোটি টাকার ঋণ সীমার বিপরীতে দায় ১০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বিআরপিডি সার্কুলার নং-১২/২০২১ এর ২.৩(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ঋণপত্র স্থাপন করা যাবে না। সিস্টার ডেনিমের ক্ষেত্রে ওই আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ঋণসীমা নবায়ন করেছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সার্কুলার অনুযায়ী তাদের নতুন ঋণসীমা অনুমোদনের সুযোগ নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, থার্মেক্স গ্রুপের ফোর্সড লোনগুলো ঋণপত্রের দায় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ফোর্সড লোনের ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও পরিশোধ করা হয়নি। এই প্রতিষ্ঠানের ঋণপত্র সুবিধা নবায়ন করা হলে আরও ফোর্সড লোন সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে করছে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করলেও ব্যাংকের দায় পরিশোধ করছে না বলেও মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপির অর্থ পরিশোধ ও খেলাপি হওয়ার পরও কীভাবে ব্যাংক পরিচালক থাকছেন—এ বিষয়ে জানতে থার্মেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদির মোল্লার একাধিক ফোন নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও সবকটি বন্ধ পাওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, থার্মেক্স গ্রুপ ২০২০ থেকে ২৩ সাল পর্যন্ত ৩৫৮ কোটি ২৮ লাখ টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি রূপালী ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেনি। এতে ব্যাংকটিতে প্রতিষ্ঠানটির দায় দিন দিন বাড়ছে। রূপালী ব্যাংক থেকে আমদানি সুবিধা গ্রহণ করে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে রপ্তানি করা হলেই কেবল এমনটি ঘটতে পারে। থার্মেক্স গ্রুপের আমদানি ঋণ সুবিধা ও রপ্তানি কার্যক্রম রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে করা হলে তাদের দায় কমার কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। তাই গ্রুপটির দায়দেনা কমানোর স্বার্থে তাদের পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়াই সংগতিপূর্ণ।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, রিজার্ভ থেকে গঠিত ইডিএফ থেকে থার্মেক্স গ্রুপকে ৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলেও তা শোধ দিতে পারেনি গ্রুপটি। বাধ্য হয়ে থার্মেক্স গ্রুপের নামে সুদে-আসলে ৭১ কোটি ৭৩ লাখ টাকার ফোর্সড লোন সৃষ্টি করেছে রূপালী ব্যাংক। পরে মাসিক কিস্তিতে ছয় মাসে তা পরিশোধের আবেদন করে থার্মেক্স। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি চেয়েছে রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি অন্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান সিস্টার ডেনিম কম্পোজিট লিমিটেডের নামে নেওয়া ১৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিতে না পারলে মন্দমানে খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কারণ, এ ঋণগুলোর মাধ্যমে রূপালী ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা অতিক্রম করেছে থার্মেক্স। অর্থাৎ মূলধনের ২৫ শতাংশ (ফান্ডেড-নন-ফান্ডেড) অতিক্রম করেছে।
সম্প্রতি এসব ঋণ আবারও পুনঃতপশিলের আবেদন করে থার্মেক্স গ্রুপ। পরে রূপালী ব্যাংক ফের পুনঃতপশিলের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে। এ ক্ষেত্রে থার্মেক্স গ্রুপের ব্যবসা চালু রাখা এবং ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থ আদায়ের স্বার্থে ঋণ পুনঃতপশিলের ক্ষেত্রে ব্যাংকের একক গ্রাহক সীমা অতিক্রম করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রূপালী ব্যাংকের সমঝোতা স্মারকের শর্ত শিথিল করার আবেদন করা হয়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, রূপালী ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটাল বা মূলধন ছিল ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। বিধি অনুযায়ী, কোনো একক গ্রাহক বা গ্রুপকে ৫৫৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই রূপালী ব্যাংকের। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, থার্মেক্স গ্রুপের ঋণ রূপালী ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ গ্রুপটি রূপালী ব্যাংকের একটি বড় গ্রাহক। কিন্তু বার্ষিক প্রতিবেদনে বড় গ্রাহকের তালিকায় নাম নেই থার্মেক্সের। ৩৬৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া গ্রাহক নোমান স্পিনিং মিলসের নাম বড় গ্রাহকের তালিকায় থাকলেও থার্মেক্সের নাম না থাকায় প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ত আরেক ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে থাকা থার্মেক্স গ্রুপের পুরো ঋণ এখন ওভারডিউ। ব্যাংকটিতে থার্মেক্স গ্রুপের দায় প্রায় ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রুপভুক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের ১২৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে, থার্মেক্স মিলাঞ্জ স্পিনিং মিলস ও থার্মেক্স চেক ফেব্রিক্স লি.। পরে নিয়ম অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠান দুটিকে খেলাপি দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে রিপোর্ট পাঠালে এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে থার্মেক্স।
এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে লড়তে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে সোনলী ব্যাংক। তবে ওই খেলাপি ঋণ থার্মেক্স গ্রুপ পুনঃতপশিল করার বিষয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছে সোনালী ব্যাংকের একটি সূত্র। এ ছাড়া গ্রুপটির অন্য ঋণগুলোও বর্তমানে ওভারডিউ বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণগুলো সচল করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিশেষ সুবিধা চেয়েছিল থার্মেক্স। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তা নাকোচ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থার্মেক্স গ্রুপের কোনো ঋণ ডাউনপেমেন্ট ছাড়া সচল না করতে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে। তাই সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে পুরো ঋণই পুনঃতপশিলের চেষ্টা চালাচ্ছে থার্মেক্স।
তবে আইন অনুযায়ী এসব ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডাউনপেমেন্ট জমা দিলে ঋণ পুনঃতপশিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সোনালী ব্যাংক। সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ থেকেও প্রতিষ্ঠানটিকে ডাউনপেমেন্ট ছাড়া কোনো পুনঃতপশিল হবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণ পুনঃতপশিল না করে সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করবে বলেও জানানো হয়েছে থার্মেক্সকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংকে থার্মেক্স গ্রুপভুক্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের দায় বর্তমানে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে থার্মেক্স চেক ফেব্রিক্স লিমিটেডের ৩৮৯ কোটি, ইন্ডিগো স্পিনিং লিমিটেডের ৩৮১ কোটি, থার্মেক্স মিলাঞ্জ স্পিনিংয়ের ৩৩১ কোটি, থার্মেক্স স্পিনিংয়ের ১৩১ কোটি টাকা, থার্মেক্স নিট ইয়ার্নের ২৪৫ কোটি টাকা দায় রয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফজাল করিম কালবেলাকে বলেন, খেলাপি হওয়ায় আমরা ইতোমধ্যে তাদের নোটিশ দিয়েছি। এর বিপরীতে তারা রিট করেছে। খেলাপি আদায়ের জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। খেলাপি অর্থ আদায়ে কাজ করছি বলেই আমাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার কমে আসছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, কোনো ব্যক্তি খেলাপি হয়ে পড়লে তিনি ব্যাংকের পরিচালক পদে থাকতে পারবেন না। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় স্পষ্ট বর্ণনা করা আছে। যদি আইন অমান্য করে কোনো খেলাপিকে পরিচালক পদে রাখা হয়, তাহলে বোর্ডের কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই কোনো খেলাপিকে বোর্ডের পরিচালক হিসেবে রাখার কথা নয়। যদিও থেকে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে অবশ্যই সেখানে আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ দেওয়া আছে। এ ছাড়া কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান যদি ঋণ গ্রহণ বা বিতরণে অনিয়ম করে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়। আবার কেউ যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সূত্র: কালবেলা